বিলাইছড়ির মনোরম স্বর্গপুর ঝর্ণাঃ যেখানে ৭টি ঝর্ণার জলধারা মিশে গেছে কাপ্তাই হ্রদে

166

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই বিলাইছড়ি হতে ফিরেঃ-স্বর্গ একটি ধর্মীয়, বিশ্বতাত্ত্বিক ও আধিবিদ্যক স্থান যেখানে বিশ্বাসীদের মতে দেবতা, দেব-দূত, আত্মা জাতীয় সত্তা, সন্ত অথবা পূজিত পিতৃপুরুষগণ রাজাসনে অধিষ্ঠিত বা বাসরত। বৌদ্ধ ধর্মে ৭টি স্বর্গের কথা বলা হয়েছে। স্বর্গগুলো হলো বসবর্ত্তী স্বর্গ, মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংস স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, যাম স্বর্গ, নির্মাণরতি স্বর্গ, অরুপব্রক্ষ্মা বা মনুষ্যলোক বা মনুষ্য পরিষদ স্বর্গ। এই ৭টি স্বর্গের নামানুসারে বিলাইছড়ি উপজেলার মনোরম স্বর্গপুরের ৭টি ঝর্ণার নামকরণ করা হয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য মন্ডিত বিলাইছড়ি উপজেলার ১নং সদর ইউনিয়ন এর ২নং ওয়ার্ড ও ৪নং ওয়ার্ডের হাজাছড়া ও দীঘলছড়ি ঢেবারমাথার মাঝামাঝি বিলাইছড়ি পাহাড় ও দীঘলছড়ি পাহাড়ের পাদদেশে ৭টি ঝর্ণা অবস্থিত। যেই ঝর্ণা হতে বছরের প্রতিটি সময় ঝিরিঝিরি শব্দে পানি প্রবাহিত হয়। যেই ঝর্ণার জলরাশি একিভূত হয়ে মিশে গেছে কাপ্তাই হ্রদের নীল জল রাশিতে। ঝর্ণা হতে বহমান জলধারার সুর লহড়ীতে হ্রদয়ের প্রতিটি তন্ত্রিতে জাগে নব জাগরণ। যেন স্বর্গের কোন দেবদূত তাঁর অপূর্ব সুরধ্বনি শুনিয়ে যাচ্ছেন মেঘমাল্লার কন্ঠে।
শুধু কি ঝর্ণার সৌন্দর্যের দেখা মিলে এই মনোরম স্বর্গপুরে? না, এইখানে দুই পাহাড়ের মাঝদিয়ে যে স্বচ্ছ জলস্রোতে দৌত প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ পাথরে আবৃত পথে অবস্থিতা রয়েছে রয়েছে বিশ-এর অধিক প্রাকৃতিক সুইমিং পুল। যেই সুইমিং পুলে ভিজে আপনি দেহ মনকে পবিত্রতায় ভরিয়ে তুলতে পারেন।
সুইমিং পুলগুলোতে রয়েছে অজস্র দৃষ্টিনন্দন নাড়েই মাছ (স্থানীয় নাম) সহ নানা প্রজাতির ছোট মাছ। নাড়েই মাছগুলো পুকুরে চাষ করা মাছের মতই। মানুষ দেখলে খাদ্যের আশায় সামনে এসে জড়ো হয় মাছগুলো। তবে এ মাছ পাড়াবাসীরা ধরে না। যারা ধরবে, প্রমাণ মিললে জরিমানা রয়েছে অনিবার্য। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এলাকাবাসীর এক সামাজিক বিধান সত্যি প্রশংসনীয়।
অবাক করা বিষয় হল এ ঝর্ণাগুলোর কোন সুনির্দিষ্ট নাম ছিলনা। সুবিস্মৃত এলাকাটিকে স্থানীয়রা বলে দীঘলছড়ি ঢেবারমাথা। ঢেবা বলতে স্থানীয়রা বুঝে লেকের সে সরু অংশ যা পাহারের ভিতরদিকে চলে যায়। ঢেবার মাথা বলতে বুঝায় এরূপ ঢেবার শেষ প্রান্ত। কাপ্তাই লেকে এরূপ অগণিত ঢেবারমাথা রয়েছে। এটি বিলাইছড়ির দীঘলছড়ি ঢেবার শেষ প্রান্তে। তাই বিস্মৃত এলাকাটি দীঘলছড়ি ঢেবার মাথা বলে পরিচিত। অফিসিয়াল আবিষ্কারের পর ঝর্ণা সংশ্লিষ্ট জায়গাটির আলাদা একটি নাম সময়ের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
বিলাইছড়ি উপজেলার সাবেক উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুজন কান্তি দাশ ২১ এপ্রিল ২০২০ তারিখ প্রকল্প পরিদর্শন কাজে দীঘলছড়ি ঢেবার মাথায় গিয়ে প্রথম জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানকে জানান যে সেখানে এরূপ একটি ঝর্ণা রয়েছে যাতে সারা বছর পানি থাকে। এ তথ্য পেয়ে প্রকৃতিপ্রেমী ও উপজেলার পর্যটন শিল্পে উন্নয়নকামী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল ১৪২৮ সালের ১০ বৈশাখ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, অফিস স্টাফ ও সাংবাদিকসহ সেখানে গিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শনের পাশাপাশি দিনব্যাপী দু:সাহসিক অভিযান পরিচালনা করে সেখানকার এ সাতটি ঝর্ণা অফিসিয়ালি আবিষ্কার করেন। ঝর্ণাগুলোর নাম জিজ্ঞেস করে কোন সুনির্দিষ্ট নাম দেয়া হয়নি জানতে পেরে সকল গ্রামবাসিকে নিয়ে একটি মিটিং-এ বসেন। মিটিং-এ গ্রামবাসির কাছে জানতে পারেন যে ঝর্ণাগুলোর কাছে যে বৌদ্ধ বিহারটি নির্মিত হচ্ছে তার নাম মনোরম স্বর্গপুর। এ জায়গায় এক সময় এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যান করত। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সবার কাছেই এটি শ্রদ্ধার জায়গা। সবার মনের এ আবেগের ব্যাপারটি জানতে পেরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রস্তাব করেন এ বৌদ্ধ বিহারের নামানুসারে স্বর্গের মত সুন্দর এ জায়গাটির নাম হতে পারে স্বর্গপুর এবং বৌদ্ধ ধর্মের সাতটি স্বর্গের নামানুসারে ঝর্ণাগুলোর নামকরণ হতে পারে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রস্তাবে খুশি হয়ে গ্রামবাসি মনোরম স্বর্গপুরের এ সাতটি ঝর্ণার নামকরণ করেন।
এই প্রসঙ্গে বিলাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান জানান, রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় অনেকগুলো ছোট বড় ঝর্ণা রয়েছে, যা দেশের অন্য কোন উপজেলায় নেই। এছাড়া এ উপজেলায় রয়েছে পাহাড় হ্রদে আর সবুজের অনন্য সমন্বয়। স্বর্গের মত সুন্দর এ জায়গাগুলোর উন্নয়ন সাধন ও এখানে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠা করে আমরা এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এলাকাবাসী জানান এ সাতটি ঝর্ণার আশেপাশে অনেকগুলো ছোট বড় ঝর্ণা আছে।
স্থানীয় কার্বারি বরুণ কার্বারি জানান, ঝর্ণাগুলো খুব সুন্দর। এইখানে লোকজন আসছে আমার খুব ভালো লাগছে। ১নং সদর ইউনিয়ন এর চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি দেওয়ান জানান, কিছুদিন আগেও ঝর্ণাগুলো পর্যটকদের কাছে অপরিচিত ছিল। বিলাইছড়ি উপজেলা ইউএনও মহোদয় আসার পর স্থানীয় সাংবাদিকরা পত্র পত্রিকায় লেখালেখির পর এটি এখন ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করছে। তিনি আরোও জানান, এই এলাকায় আসার পথটুকু খুবই নাজুক। সরকার যদি এই এলাকায় আসার যে পথ আছে সেখানে রাস্তাঘাট নির্মাণ করে দেয়, তাহলে এই এলাকার পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।
গত শনিবার সকালে ঝর্ণা দেখতে আসা কাউখালি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন আরা সুলতানা এবং তাঁর স্বামী ফটোগ্রাফার ব্যাংকার অহিদুল হাসান জানান, এখানে না আসলে বুজতে পারতাম না ঝর্ণাগুলো এত সুন্দর। এখানে ঝর্ণার পাশাপাশি অনেকগুলো সুইমিংপুল আছে। এই সুইমিংপুলে ভীজে মনকে হিমশীতল করতে পারি।
ঝর্ণা দেখতে আসা গাজীপুরের হানিফ মিয়া, কুষ্টিয়ার সুমন জানান, প্রতিটি ঝর্ণা দিয়ে অবিরাম ধারায় পানি পড়ছে, মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।
রাঙ্গামাটি সদর কিংবা কাপ্তাই জেটিঘাট হতে ইঞ্জিন চালিত বোটে ঘন্টা দেড়েক পর বিলাইছড়ি উপজেলায় পৌঁছাতে হয়। এরপর বিলাইছড়ি সদর হতে ধুপ্যাচর, দীঘলছড়ি পার হয়ে ২০ মিনিট ইঞ্জিন চালিত বোটে পাড়ি দিয়ে ঢেবার মাথা যাওয়া পর আরোও ৩০ মিনিট পায়ে হেঁটে এই ঝর্ণায় পৌঁছানো যায়।
১নং সদর ইউনিয়ন এর এই দুই ওয়ার্ডে যেখানে ঝর্ণাগুলো অবস্থিত সেখানে ৬০টি চাকমা পরিবারের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ৪ শ। কৃষি জমি চাষ এবং জুম চাষের উপর তারা জীবন জীবিকা নির্বাহ করে।
বিলাইছড়ি উপজেলার মনোরম স্বর্গপুরের এই ৭টি ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আগের দিন এসে রাত্রিযাপন করে পরের দিন সকালে ঐ এলাকায় গেলে প্রতিটি ঝর্ণার সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করা যাবে। রাত্রি যাপনের জন্য বিলাইছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড়ের সু মনোরম পরিবেশে তৈরী করা হয়েছে নীলাদ্রি রিসোর্ট। এই নীলাদ্রি রিসোর্টে ৫টি কটেজ রয়েছে। কটেজ এর করিডোরে বসে দূর পাহাড়ের মেঘ বৃষ্টির মিতালি আপনাকে নিয়ে যাবে কল্পনার রাজ্যে। কটেজ সংলগ্ন উপজেলা ক্যাফে ও উপজেলা কেন্টিনে উন্নত মানের খাবার এর ব্যবস্হা রয়েছে। এছাড়া বিলাইছড়ি বাজারের আশেপাশে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠছে অনেক থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা। সবকিছু নিয়ে বিলাইছড়ি উপজেলা এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটন শিল্পের বিকাশের দিকে। সবকিছু বিবেচনায় আশা করা যায় বাংলাদেশের অনন্য সুন্দর এ উপজেলাটি দেশ বিদেশের পর্যটকদের অনন্য প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। কৃষি ও প্রাণিসম্পদের পাশাপাশি পর্যটন শিল্প হয়ে উঠবে বিলাইছড়ি উপজেলার অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি।