পাহাড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় মসলা চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে

355

উচিংছা রাখাইন, রাঙ্গামাটিঃ-তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষে স্থানীয় কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। এ এলাকার জমি মসলা জাতীয় ফসল ও ফলের বাগানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পার্বত্য এলাকার প্রান্তিক কৃষকদের জন্য গ্রহণ করেছে উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ প্রকল্প।
এক সময় পাহাড়ে মসলা বলতে শুধু আদা, হলুদের চাষকে বুঝাত। কিন্তু এখন পাহাড়ের কৃষকরা জুম চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের উচ্চ মূল্যের মসলা চাষের দিকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এবং অনেক কৃষক মনে করছেন এই মসলা চাষের মাধ্যমে তারা অধিক লাভবান হবেন এবং এর থেকে তারা অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে।
পরিবশেবিদদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আবহাওয়া বিবেচনায়, এখানে উদ্যান ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। দরিদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের উদ্যান ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা সবচে ভাল উদ্যেগ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ’ প্রকল্পটি একটি পাইলট প্রকল্প। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চার বছর এ প্রকল্পের মেয়াদ। পাটইলট প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি ৮৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় উন্নত জাতের উচ্চ মূল্যের মসলা যেমন-দারুচিনি, তেজপাতা, আলুবোখারা, গোলমরিচ, জুম মরিচ, ধনিয়া, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি চাষাবাদ করে দেশের চাহিদা পূরণ করা যাবে। এসব ফসলের আবাদের ফলে কৃষকগণ লাভবান হবেন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছেন, এ প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলা ২ হাজার ৬শ জন কৃষককে মসলা চাষের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত কৃষকদের বিনামূল্যে আলুবোখরা, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ ইত্যাদি মসলার চারা-কলমও প্রদান করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ’ প্রকল্প অফিস জানিয়েছেন, এর পাশাপাশি তাদেরকে প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি, সার ও রোপন কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্বল্প সময়ে আয়ের জন্য কৃষকদেরকে সাথী ফসল হিসাবে পেঁপে চারা, উন্নত জাতের পেয়ারা ও জলপাই চারাও প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে, রাঙ্গাামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের বরাদম এলাকার মসলা মসলা বাগান সৃজনকারী চাষী যুদ্ধমনি চাকমা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে আমাকে উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ করার জন্য দারুচিনি, গোলমরিচ, তেজপাতার চারা, সার ও সেচ যন্ত্রপাতি দিয়েছে। আমি এখন জুমচাষ বাদ দিয়ে মসলা চাষ করছি। আশা করছি এই মসলা চাষে আমি লাভবান হব। তিনি বলেন, তার সৃজিত বাগান দেখে এলাকার অনেকেই মসলা বাগান করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বরাদম এলাকার আরেক কৃষক রতন চাকমা বলেন, উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় আমি আমার বাগানে দারুচিনি, আলুবোকরা ও পেঁেপ ও পেয়ারা বাগান করেছি। আমি উন্নয়ন বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই আমাকে মসলা চাষের বাগান করার জন্য সহযোগিতা করায়।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মসলা চাষ প্রকল্পের রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মাঠ সংগঠক জগদীশ্বর চাকমা জানান, এখানকার কৃষকরা তারা আগে জুম চাষ করতো বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে মসলা চাষ সম্পর্কে কোন ধারনা ছিলনা। এই প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর কৃষকদেরকে প্রথমে আমরা উদ্বুদ্ধ করি যে, আপনারাতো জুম চাষ করেন জুম চাষের পরিবর্তে মসলা চাষ করেন। কৃষকদরে আমরা কিভাবে চারা রোপন করতে হয়, জৈব সার বীজ করতে এগুলো হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তিনি বলেন, এখানে আলু বোখরার চারার বৃদ্ধিটা খুব তাড়াতাড়ি হয়।
উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, এ মসলা চাষ প্রকল্পটি একটি ব্যাতিক্রমধর্মী প্রকল্প। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ের দূর্গম এলাকায় কম ওজনের উচ্চ মূল্যের ফসলের চাষ করার নির্দেশনায় দিয়েছে। সে নির্দেশনা মোতাবেক আমরা পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষকরা যাতে মসলা চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারে সে উদ্যেগে নিয়েছি এ প্রকল্পের মাধ্যমে। তিনি বলেন, তুলনামুলক দূর্গম স্থানে উচ্চ মূল্যের ও কম ওজনদার মসলা ফসল চাষাবাদের সুযোগ রয়েছে। এসব ফসল কম ওজনদার, দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য ও মূল্যবান হওয়ায় কৃষকগণ নিজ ঘরে তা সংরক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সময়ে সহজে দূরের বাজারে নিয়ে বিক্রি করে অধিক অর্থ পেতে পারে। মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আরো বলেন, এটি হচ্ছে একটি পাইলট প্রকল্প। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বড় আকারে পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষকদের জন্য মসলা চাষ প্রকল্পটি হাতে নিতে পারবো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ে এখনো অনেক অনাবাদী জমি রয়েছে যেখানে মসলা চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে মসলার যে চাহিদা এবং আমদানীর মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করার জন্য বর্তমান সরকার এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। এই মসলা চাষ প্রকল্পটি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে রয়েছে আলু বোকরা, তেজপাতা ও গোল মরিচ। প্রকল্প পরিচালক আরো বলেন, আমরা এই মসলা চাষ প্রকল্পে সাথী ফসল হিসেবে কৃষকদের পেয়ারা এবং পেঁেপ চারা দিয়েছি। পেয়ারা এবং পেঁপে থেকে কৃষকরা ছয়মাস থেকে এক বছরের মধ্যে লাভবান হচ্ছে।
মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, এসব মসলাগুলোর আমাদের দেশে চাহিদা অনেক বেশি। এর চাহিদা পূরণ করতে পারলে আমরা দেশে আমদানী নির্ভরতা কমাতে পারবো। পাহাড়ের কৃষকরা কিন্তু খুবই উৎসাহী মসলা চাষে। অনেক কৃষক ইতিমধ্যে আলু বোকরার নার্সারী করে চারা কলম নিজেরা বিক্রয় করছে।
এই প্রসঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমানে আর্থ-সামজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি ভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এ এলাকার যারা প্রান্তিক জনগণ আছে তাদের কিভাবে আমরা অর্থনেতিকভাবে উন্নতি করা যায়।
নিখিল কুমার চাকমা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চিন্তা প্রসুত একটি প্রতিষ্ঠান। তারই ফল শ্রুতিতে উন্নয়ন বোর্ডের সৃষ্টি। তিনি বলেন, পাহাড়রে কৃষকরা মসলা চাষে অত্যন্ত আগ্রহী কারন আমি কয়েকটি বাগান পরিদর্শনে গিয়ে তা উপলব্ধি করেছি। চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দূর্গম এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ তেমনই একটি পাইলট প্রকল্প। এই প্রকল্পের সফলতা হলে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।