বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ২০২৩ পেলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তী কবি মৃত্তিকা চাকমা

124

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সাহিত্য জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী কবি মৃত্তিকা চাকমা। দীর্ঘ সময় ধরে এই খ্যাতিমান সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিজ ভাষা ও বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। প্রকাশনার সাথেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ছড়াথুম পাবলিশার্সের মাধ্যমে।
আর এই ধারাবাহিকতায় নাট্য সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ পেলেন কবি মৃত্তিকা চাকমা। কবি মৃত্তিকা চাকমা ১২ জানুয়ারী ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মৃগাছড়িতে জন্মগ্রহন করেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৬ জন এই পুরস্কার পাচ্ছেন। বুধবার (২৪ জানুয়ারী) বাংলা একাডেমি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ পাচ্ছেন- কবিতায় শামীম আজাদ, কথা সাহিত্যে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী, প্রবন্ধ/গবেষণায় জুলফিকার মতিন, অনুবাদে সালেহা চৌধুরী, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক, শিশুসাহিত্যে তপংকর চক্রবর্তী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় আফরোজা পারভীন ও আসাদুজ্জামান আসাদ, বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষণায় সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও মো. মজিবুর রহমান, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে ইনাম আল হক, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ ভ্রমণকাহিনী/মুক্তগদ্যে ইসহাক খান, ফোকলোরে তপন বাগচী ও সুমন কুমার দাশ।
মৃত্তিকা চাকমার সংক্ষিপ্ত জীবন ও কবিতাঃ
কবি মৃত্তিকা চাকমা জন্মগ্রহন করেন ১২ জানুয়ারী ১৯৫৮ খ্রি: রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের মৃগাছড়িতে (বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধের জলমগ্ন কাবত্যাদ্যেরে)। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নি:স্ব করেছে রাঙ্গামাটির হাজার হাজার মানুষকে যা থেকে বাদ পড়েনি কবির পরিবারও। এ বাঁধের ফলে রাঙ্গামাটির বন্ধুকভাঙ্গা ত্যাগ করে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানার লোগাং এ চলে যেতে হয় কবির পরিবারকে। কবি মৃত্তিকা চাকমার শৈশব কাটে লোগাং এর মাটি ও মানুষের সাথে। লোগাং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে শেষ হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ (স্নাতক) এম.এ (স্নাতকোত্তর) ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে। কবি মৃত্তিকা চাকমা মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ সাল থেকে এখনো শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত রয়েছেন। স্ত্রী শৈব রানী চাকমা দুই সন্তান ড্যানিস চাকমা ও নিসা চাকমাকে নিয়ে ছোট পরিবার। পিতা যুবনাশ্ব চাকমা ও মাতা রাজলক্ষী চাকমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন জুম ইসথেটিক কাউন্সিল জাক এর নীতি নির্ধারক ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাক-এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে এবং নিজ উদ্যোগে জুমিয়া সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগতি সাধনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
এছাড়া আদিবাসী কবিতা পরিষদ, হিল চাদিগাং থিয়েটার সহ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে থেকেছেন। এ পর্যন্ত ১২টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কবিতা ছয়টি, নাটক চারটি, প্রবন্ধ ২টি। এ ছাড়াও প্রকাশনায় অপেক্ষায় রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-মেঘ সেওে মোনো চুক (কবিতা), মন পরানী (কবিতা), এখনো পাহাড় কাঁদে (বাংলা ভাষার কবিতা), দিকবন সেরেততুন (কবিতা), একজুর মান্নেক (ম নাটক), বান (ম নাটক) ইত্যাদি।
এ কবি সন্মাননা পেয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে। তার মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যেও তোলবিচ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা (২০০৩), স্বাধীনতা সংসদ সন্মাননা, ঢাকা(২০১০), আন্তর্জাতিক জলঙ্গী কবিতা উৎসব সন্মাননা, নদীয়া ভারত (২০১০) উল্লেখযোগ্য।
কবি মৃত্তিকা চাকমা বলেন, আমার লেখালেখি শুরু হয় কাঠালতলী হাই স্কুলে থাকাকালীন কোন এক সময়। দেয়ালিকার জন্য লেখা ছোট একটি কবিতা লিখে জমা দিয়েছিলাম পরে ওটা প্রকাশ হয়েছিলো কি না জানি না। শুধু লিখেছিলাম তা মনে আছে। পরে সাপ্তাহিক বনভূমি পত্রিকা আর চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক যুগরবি পত্রিকার মাধ্যমে লেখালেখিতে আসি। বলা যায় ওই দুটো পত্রিকাতেই আমার লেখালেখির শুরু। আমার প্রথম লেখার মাধ্যমে ছিল কবিতা। দ্বিতীয় মাধ্যম নাটক। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে যখন পড়াশুনা করি তখনই জানতে পারলাম সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যম। নাট্য সাহিত্যে আমাকে অনুপ্রেরণা যোগিয়েছিলেন জিয়া হায়দার স্যার। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। গল্প, প্রবন্ধ আর গানও লিখেছি। উপন্যাসে হাত দিয়ে রেখেছি, তবে ভয় হয় পৌঁছাতে পারবো কিনা! তাই সে বিষয়টা আপাতত বিরত রেখেছি।
কবি মৃত্তিকা চাকমা তার জীবনী নিয়ে আরো বলেন, আমার এক মামা দেব সিংহ চাকমা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ভাগ্নে লেখাপড়া শেষ করে কি করবে? আমার উত্তর শিক্ষকতা। মামা শুনে খুশি হয়েছিলেন। আমাকে আশির্বাদ করেছিলেন, তুমি যেন একজন ভাল শিক্ষক হও। জানিনা আমি হতে পেরেছি কিনা। তবে শিক্ষক হয়েছি একটি এতিমখানা শিক্ষক হিসেবে। হয়তো ঐ সরকারী চাকরীতে যোগদান করলে ঢাকা-চট্টগ্রাম কথা বাদ, অন্তত রাঙ্গামাটিতে একটি ছোট খাটো বিল্ডিং এর মালিক হতে পারতাম। এখন যেমন ভাঙ্গা ঘরে জীবন যাপন বর্ষা আসলে পানি নিষ্কাশনের জন্য বেলচা, গামলা, ফাটাছেড়া কাপড় নিয়ে পানি নিষ্কাশন করতে হয়। আর চিন্তা করলাম সাহিত্যে পড়াশুনা করে শুধু শিক্ষকতা নিয়ে জীবনটা শেষ করে দিলে সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করায় অনর্থক। ভাবলাম জাতিকে কিছু দেওয়ার সুযোগ তো রয়েছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যটাও চালিয়ে যাওয়ার দরকার। কারণ আমার এ জুম্ম জাতির যে সাহিত্যে, সংস্কৃতি বিশাল ভান্ডার ছড়িয়ে ছিঠিয়ে রয়েছে এগুলো তো উদ্ধার করতে হবে। একজনের না হয় একজনের রাস্তা তো দেখিয়ে যেতে হবে। মূলত এ ভাবনা থেকে আমার সাহিত্যে চর্চা বেঁচে নেওয়া।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আশির দশকের খ্যাতিমান কবি ও প্রতিভাবান ব্যক্তি মৃত্তিকা চাকমা। কাপ্তাই বাঁধের ফলে বাস্তুভিটা হারিয়ে পরিবারের সঙ্গে শৈশবে উদ্বাস্তু হন তিনি। ফলে তাঁর কবিতায় প্রকৃতির পাশাপাশি দ্রোহের উচ্চারণ এসেছে বারবার। তাঁর ‘হৃদয়ে পাহাড় কাঁদে’ কবিতার শেষ পঙক্তি তুলে ধরা হলোঃ
আমি কবুল করেছি এ বিঝুতে আমি যাবো না
অর্ধ লক্ষ মা-বাবা-ভাইবোন
আত্মীয়স্বজনের প্রেক্ষিতে, ক্ষতবিক্ষত পাহাড়।
মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি চাকমা সাহিত্য সমাজকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
মৃত্তিকা চাকমার আলোচিত একটি কাব্যগ্রন্থের নাম গঝক। এ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে কবি বলেছেন, ‘আমার এ গ্রন্থের নামকরণ করছি ‘গঝক’। বাংলা ভাবানুবাদ করলে যা দাঁড়ায় জবরদখল বা খর্ব হওয়া। যেমন সাম্প্রতিক বিশ্বে একটু নজর দিলে চোখে পড়ে জবরদখলের সরাসরি। যেমন নদী দখল, ভূমি দখল, পাহাড় দখল। এক দেশের প্রতি আরও এক দেশের জবর দখল। যেমন ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমিতে ইসরাইলিদের দখল। ভারতের সীমান্ত অঞ্চল লাদাখসহ তিব্বতীদের জন্মভূমি চীনাদের দখলে। এ ধরনের প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে কার ভূমি কে দখল করছে তার কোনো পরিসীমা নেই।”