সাফজয়ী ৫ পাহাড়ী কন্যাকে রাঙ্গামাটিবাসীর বীরোচিত সংবর্ধনা

55

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙ্গামাটিঃ-হাজারো পাহাড় বাসীর ফুলেল শুভেচ্ছা সিক্ত হলো নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ী পাহাড়ের পাঁচ নারী ফুটবলার। রাঙ্গামাটি চিংহ্লা মং মারী স্টেডিয়ামে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ী পাহাড়ের পাঁচ নারী ফুটবলার আনাই, আনুছিং, রুপনা, ঋতুপর্ণা ও মনিকাকে বীরোচিত এ সংবর্ধনা দেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বিরোচিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নগদ অর্থ, ক্রেষ্ট ও ফুলেল শুভেচ্ছা তুলে দেন, রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী, বিজিবি সেক্টর কমান্ডার অধিনায়ক কর্ণেল মোঃ তরিকুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোঃ আশিকুর রহমান, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ, রাঙ্গামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ মুছা মাতব্বর, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী তুষিত চাকমা, মঘাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীর সেন চাকমাসহ রাঙ্গামাটির সর্বস্তরের প্রশাসন নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের যৌথ উদ্যোগে ঘাগড়া স্কুল থেকে তাদেরকে ছাদখোলা গাড়িতে চড়িয়ে রাঙ্গামাটি শহরে নিয়ে আসা হয়। এ সময় রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় গ্রামবাসী খেলোয়াড়দের ফুল ছিটিয়ে উষ্ণ অর্ভথনা জানান। প্রায় ২ ঘন্টা ছাদ খোলা বাসে চড়ে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়ামে এসে বিজয় মিছিল শেষ হয়। এ সময় খেলোয়াড়রা হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানান।
পরে বিকেল ৫ টায় রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়ামে বিজয়ী পাহাড়ের পাঁচ নারী ফুটবলারকে ফুল দিয়ে বীরোচিত সংবর্ধনার স্থলে বরণ করে নেয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও সম্প্রীতির নৃত্যের মাধ্যমে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এসময় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাফ জয়ী মিডফিল্ডার ঋতুপর্ণ চাকমা খেলোয়াড়দের পক্ষে বলেন, এতো বড়ো আয়োজন আমাদের মুগ্ধ করেছে। রাঙ্গামাটির মানুষ যে আমাদের এতো ভালোবাসে তা আমরা কল্পনা করতে পারিনি। রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ ও রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই হাজার হাজার মানুষের মাঝে রেখে আমাদেরকে সংবর্ধিত করছে। তিনি বলেন, আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের শিক্ষক ও কোচদের কাছে। যাদের কল্যাণে আজ আমরা এই অবস্থানে উঠে এসেছি। তারা যদি আমাদের পাশে না থাকতো তাহলে আমরা কখনোই আজ এতো বড়ো হতে পারতাম না। ঋতু বলেন, পাহাড়ের প্রতিটি নারী সুযোগ পেলে তার প্রতিভা গড়ে তুলবে। ঘাগড়া স্কুলকে জাতীয় করণ করে রাঙ্গামাটিতে ফুটবল একাডেমী ও হোষ্টেল গড়ে তোলার জন্য আহবান জানান।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সাফ জয়ী ৫ নারী আমাদের গর্ব। তাদের কল্যাণে আজ বাংলাদেশ বিশ^ দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। তাদের এই অবদানের পেছনে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন না করতে তাহলে এই কন্যারা উঠে আসতো না। তিনি বলেন, তাদের সংবর্ধিত করতে পেরে আমরা আজ গর্বিত।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, পার্বত্য রাঙ্গামাটির প্রতিটি গ্রামেরপ্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। আগামীতে প্রাথমিক স্কুলে যাতে আরো বেশী খেলাধুলা হয় তার জন্য রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ অবশ্যই কাজ করবে। তিনি বলেন, পার্বত্য রাঙ্গামাটির অহংকার দীপংকর তালুকদারের স্বদিচ্ছায় রাঙ্গামাটির হ্যাচারী এলাকায় একটি ক্রীড়া একাডেমীর জন্য হোষ্টেল নির্মাণ কাজ শুরু করা হবে। ইতিমধ্যে আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই হোস্টেলে রাঙ্গামাটির দুর্গম এলাকার প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা এখানে থেকে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের নারীরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা কোন ভাবেই পিছিয়ে নেই। রুপনা চাকমা যেভাবে গোলবারকে পাহাড়া দিয়ে দেশের জন্য সোনা নিয়ে এসেছে তা আমাদের জন্য বড়প্রাপ্তি। পার্বত্য রাঙ্গামাটির ও পার্বত্য অঞ্চলের জন্য প্রাপ্তি। তিনি বলেন, তোমাদের চলার পথ এখানে যাতে থেমে না যায়। আগামীতে বিশ^কাপ জয় করে নিয়ে আসতে হবে। দীপংকর তালুকদার বলেন, জাতির পিতার কন্য শেখ হাসিনা নারী তাই নারীদের তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করে তিনি প্রমান করে দিয়েছেন নারীদের সুযোগ দিলে তারা দেশের জন্য কিছু করতে পারে। তিনি বলেন, অনেকেই অনেক কথা বলেছে। বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করাকে নিয়ে। ২০১০ সালে টুর্নামেন্টের শুরু দিয়ে আমাদের মেয়েরা উঠে এসেছে। মেয়েরাই আজ দেশের জন্য স্বর্ন পদক নিয়ে এসেছে। এই ধারা আমাদের ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, যে স্কুল লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাই ভালো করবে তাদের পৃষ্টপোষক আমরা অবশ্যই করবো।
পরে খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরর সভাপতি প্রতিটি খেলোয়াড়রকে ৫০ হাজার টাকা এবং ২জন কোচকে ২৫ হাজার টাকা, উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রতিটি খেলোয়াড়রকে ৫০ হাজার টাকা এবং ২জন কোচকে ২৫ হাজার টাকা, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ থেকে প্রতিটি খেলোয়াড়রকে ২ লক্ষ টাকা করে এবং ২জন কোচকে ২৫ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। এছাড়া বিজিবি সেক্টর কমান্ডার, রাঙ্গামাটি জোন, রাঙ্গামাটি পৌরসভা সহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ক্রেষ্ট ও সম্মাননা প্রদান করা হয়।
এ ছাড়াও রাঙ্গামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থা, রাঙামাটি মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ফুটবল একাডেমী, মারমা সংস্কৃতি সংস্থা ও ঘাগড়া ইউপির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাতে জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে মগাছড়ি এলাকায় সাফ জয়ী খেলোয়ার ঋতুপর্ণা চাকমার বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে দুই শতাধিক গ্রামবাসী তাদের প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ মশাল জ্বালিয়ে বরণ করে নেন।
গ্রামবাসীরা রূপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমা, আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এসময় বীরসেন তঞ্চগ্যা, শশী মোহন চাকমা ও শান্তি মনি চাকমাসহ দুই শতাধিকের অধিক গ্রামবাসী উপস্থিত ছিলেন।
এসময় গ্রামবাসীরা বলেন, ঋতুপর্ণা আমাদের গ্রামের মেয়ে। সে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ফুটবল খেলে দেশের সুনাম বয়ে এনেছে। আমরা গর্বিত ওর জন্য। তাই আমরা ঋতুপর্ণা চাকমাসহ বাকিদের বরণ করে নিতে এ আয়োজন করেছি।
ঋতুপর্না চাকমা বলেন, আমরা অনেক দিন পর বাড়ি ফিরেছি। গ্রামবাসী আমাদের এভাবে বরণ করে নিবে আমরা আসার আগেও চিন্তা করে নি। আমরা কৃতজ্ঞ।
আনাই মগিনী বলেন, আমার বাড়ি খাগড়াছড়ি হলেও আমার অনেক বেশি সময় কেটেছে এ ঘাগড়া স্কুলে। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাও শিখেছি। আমি ছুটি পেলে বাড়িতে দেখা করার পর এখানে চলে আসি স্যারদের সঙ্গে সময় কাটাই। আমরা যারা আজ দেশের হয়ে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছি আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
বীরসেন তঞ্চগ্যা বলেন, অনেকদিন পর ওদের সঙ্গে দেখা হলো। খুবই ভালো লাগছে। আমি প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন সময়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্টে জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ দলে এ পাঁচজন ছিল। সেই থেকে তাদের পথচলা। আমি আজ তাদের জন্য গর্বিত।
পার্বত্য জেলার পাঁচ ফুটবলারের মধ্যে রূপনা ও ঋতুপর্ণার বাড়ি রাঙ্গামাটিতে আর মনিকা, আনাই ও আনুচিংয়ের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলায়। তারা সবাই রাঙ্গামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।