গাউসুল আজম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এঁর জীবনী – মোঃ সাইদুল হক, সহকারী শিক্ষক, কাউখালী

1934

ইসলামের মহান বানী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য দুনিয়াতে যুগে যুগে যে সকল ওলি-আল্লাহর আবির্ভাব ঘটেছে তন্মধ্যে বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) অন্যতম। সে কারণে তাঁকে গাউসুল আজম হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর জন্ম ও পরিচয়: বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) পহেলা রমযান ৪৭০ হিজরী বা ১৯ মার্চ, ১০৭৮ খ্রিঃ বাগদাদের জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম সৈয়্যদ মহিউদ্দীন আবু মুহাম্মদ আব্দুল কাদির আল-জিলানী আল-হাসানী ওয়াল-হুসাইনী। তাঁর পিতার নাম আবু সালেহ মুছা জঙ্গী। মাতার নাম সাইয়েদা উম্মুল খায়ের ফাতেমা।

তিনি ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর বংশধর। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর জন্ম ইরাকের অন্তর্গত জিলান নামক স্থানে হয় বলে তাকে জিলানী বলা হয়। তার উপাধি ছিল আবু মোহাম্মদ মুহিউদ্দীন।
ছোটবেলা:

হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(রহ:) এঁর বয়স যখন মাত্র ৫ বৎসর তখনই তিনি পিতৃহীন হন। তার লালন-পালন ও পড়াশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের উপর।

মা চরকায় সুতা কেটে জিবীকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। মাতা পুত্রকে কখনও কখনও অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। যেদিন ঘরে কিছু খাবার না থাকতো তখন মা বলতেন,”আজ আমরা আল্লাহপাকের মেহমান।

”খুব অল্প বয়সেই হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ:) মকতবে যাওয়া শুরু করেন। বাল্যবয়সেই বিভিন্ন আলৌকিক ঘটনাও ঘটতে শুরু করে। একবার সমবয়সী বালকদের সাথে খেলায় যোগ দেয়ার ইচ্ছা করলে গায়েবী আওয়াজ এলো,”হে বরকতময় সত্তা ,আমার কাছে এসো!”কথা শোনা গেলেও কন্ঠটি কার বা কোত্থেকে এলো কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না।
তাছাড়া কোন লোকও তিনি সেখানে দেখতে পেলেন না।তাই ভয়ে দৌড়ে তিনি ময়ের কাছে চলে এলেন। এরকম আরো বহুবার হয়েছে।একবার নিদ্রাকাতর অবস্থায় সুখময় নিদ্রা যাচ্ছিলেন।

এমন সময় ঘুমের ঘরে তিনি স্বপ্নে দেখিলেন-একজন উজ্জল জ্যোতি বিশিষ্ট স্বর্গীয় ফিরেশতা তাহার শিয়রের নিকট এসে অত্যন্ত কোমল স্বরে বলিতেছেন- ”হে আল্লাহর মনোনিত আব্দুল কাদির! উঠ,আর নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থেক না।
সুখ শয্যার কোলে ঢলে পড়বার জন্য এই পৃথিবীতে তোমার আগমন ঘটেনি। তোমার কর্তব্য ও দায়িত্ব সুদুরপ্রসারী! মোহগ্রস্থ,নিদ্রাচ্ছন্ন জনগনকে নিদ্রার মোহ থেকে মুক্ত করিবার জন্যই তোমার আগমন ঘটেছে।

শিক্ষা জীবন ও ধর্ম প্রচার:
হযরত আব্দুল কাদির জিলানী(র:) এর বাল্য শিক্ষার হাতে খড়ি হয়েছিল জ্ঞানবান পিতা ও গুনবতী মাতার মাধ্যমে। তিনি স্বীয় পিতা -মাতার মাধ্যমেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষনীয় বিষয়গুলি গৃহে বসেই সমাপ্ত করেছিলেন। সর্বপ্রথমেই তিনি পবিত্র কুরআন পাঠ করা শিক্ষা করেন ও সম্পুর্ণ কুরআন হেফজ করেন।
গৃহশিক্ষার বাইরেও তিনি জিলান নগরের স্থানীয় মক্তবেও বিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন। একবার তিনি মক্তবে উপস্থিত হলে সেখানে বসার জন্য কোন স্হান পাচ্ছিলেন না।

এমন সময় অদৃশ্য হতে আওয়াজ হলো,”হে শিক্ষার্থীগণ!এই বালকের জন্য তোমরা একটু স্থান করে দাও,যাতে তিনি বসতে পারেন।” কেহই আওয়াজের দিকে তেমন লক্ষ্য দিল না।পরিশেষে আবার গম্ভীর কন্ঠে দৈববানী ঘোষিত হলো, ”হে শিক্ষার্থীগণ! তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে,আল্লাহর প্রিয় অলী দ্বারে দাড়িয়ে আছে ?

উঠ,তাঁকে বসার স্থান করে দাও। অযথা বিলম্ব করে সময় অপচয় কর না।”এই অদৃশ্য বানী ছাত্র শিক্ষক সকলের কর্নেই ভীষনভাবে আঘাত করল।সকলেই হতচকিত ও বিস্ময়াপন্ন হয়ে গেল এবং বড় পীর আব্দুল কাদির (রহ:) কে বসবার স্থান করে দিল।

তার প্রখর ধীশক্তি,প্রত্যুতপন্নমতিত্ব ও আল্লাহ প্রদত্ত প্রজ্ঞার ফলে বাল্যকালেই তিনি অসাধারন পান্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হন। কোন এক জিলহজ্ব মাসের ৯ম দিবসে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেলেন। সেখানে এক গাভীর গায়ে হাত দিতেই গাভীটি তার দিকে তাকালো এবং বলতে লাগলো,”হে হযরত আব্দুল কাদির !

আল্লাহ পাক তোমাকে কৃষিকাজের জন্য সৃষ্টি করেন নি বা জীবিকা অর্জনের হুকুমও তোমাকে দেননি”গাভীর মুখে কথা শুনতে পেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় বাড়ী ফিরে এলেন এবং মনের উদ্বেগে ঘরের ছাদে উঠে নানা কথা ভাবছিলেন।
এমনসময় তিনি দেখতে পেলেন মক্কা শরীফ পর্যন্ত সমস্ত এলাকা তার সামনে উন্মুক্ত । চোখের সামনে তিনি আল্লাহর ঘর দেখতে পেলেন। তিনি আরো দেখতে পেলেন আরাফাতে হাজ্বী সাহেবরা অবস্থান করছেন।

অতএব গায়বী ইঙ্গিতের মর্ম বুঝতে চেষ্টা করে তিনি মাকে দ্বীনী উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদ গমনের ইচ্ছার কথা জানালেন। মা হৃষ্টচিত্তে অনুমতি দিয়ে তার পাথেয় প্রস্তুতিতে লেগে গেলেন। রওনার দিন জামার ভেতরে ৪০টি স্বর্নমুদ্রা সেলাই করে দিয়ে তার মা বললেন,”আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হও। সততা ও বিশ্বস্ততাকে নিজের আদর্শরুপে শক্ত হাতে ধারন করবে।”

ঘটনাক্রমে রাস্তায় ডাকাত পড়লো।এক ডাকাত শিশু আব্দুল কাদিরকে তার কাছে কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করলো। তিনি অকপটে স্বীকার করলো জামার ভিতর সেলাইকরা ৪০টি স্বর্নমুদ্রার কথা। বালকের সততায় ও সরলতায় ডাকাত মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো, এবিপদের মুহুর্তে লোকেরা প্রকাশ্য সম্পদও গোপন ফেলে আর তুমি এ গোপন সম্পদের কথা কেন আমাকে দিলে ?
বালক আব্দুল কাদির জবাব দিল,”আমার আম্মা আমাকে সর্বদা সত্য কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন।”

আল্লাহ-ওয়ালাদের কথায় এমন প্রভাব থাকে যা পাষান হৃদয়ও একমুহুর্তে গলিত হতে পারে। ডাকাত সর্দার কাদতে শুরু করলো এবং বলল,”এ বালকটি তার মায়ের নির্দেশ এত বিপদের মধ্যেও যেভাবে মানল ,আমি কি আমার সৃষ্টিকর্তা প্রভূর হুকুম কি এভাবে মানছি ? আমিতো অর্থ-সম্পদের লোভে মহান মহান মালিকের অবাধ্য হয়ে শত শত মানুষের সর্বনাশ করছি”।
কাফেলার লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দিয়ে ডাকাত তার গোটা দলসহ তওবা করে ডাকাতি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো । বলা হয় এই ব্যক্তিটিই নাকি পরবর্তীতে আল্লাহর এক ওলীতে পরিণত হয়েছিলেন। (আল্লাহই ভালো জানেন)।

উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ৪৮৮ হিজরীতে যখন প্রথম তিনি বাগদাদ গমন করেন তখন তার বয়স হয়েছিল আঠার বৎসর।
বাগদাদ এসে তিনি শায়েখ আবু সাইদ ইবনে মোবারক মাখযুমী হাম্বলী,আবুল ওয়াফা আলী ইবনে আকীল এবং আবু মোহাম্ম ইবনে হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ র: এর নিকট ইলমে ফিখ,শায়েখ আবু গালিব মুহাম্মদ ইবনে হাসান বাকিল্লানী,শায়েখ আবু সাইদ ইবনে আব্দুল করীম ও শায়েখ আবুল গানায়েম মুহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহম্মদ র: প্রমুখের নিকট এলমে হাদীস এবং শায়েখ আবু যাকারিয়া তাবরেয়ী (রহ:) নিকট সাহিত্যের উচ্চতর পাঠ লাভ করেন।

শায়খ জীলানীর বাহ্যিক ও আধ্যাতিœক জ্ঞান চর্চার গূরু শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমীর মনে তরুন এ শিষ্যের যোগ্যতা ও প্রতিভা সম্পর্কে এতই সুধারনা ও আস্থাশীলতার সৃষ্টি করল যে, নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা তত্ত¦াবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)এর নিকট অর্পন করে তিনি নিজে অবসর গ্রহন করেন।

তখন তিনি এ মাদ্রাসার উন্নতি ও উৎকর্ষের কাজে আতœনিয়োগ করেন। হাদীস ,তাফসির,ফিকহ ও অন্যান্য জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষাদান নিজেই শুরু করেন। পাশাপাশি ওয়াজ নসিহত ও তাবলিগের কর্মসুচীও চালু করেন ।

অল্পদিনের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারিদিকে ছরিয়ে পড়লো এবং দেশ বিদেশের বিদ্যার্থীরা এতে ছুটে আসতে লাগলো। এ পর্যায়ে মাদ্রাসার নামকরনও শায়খের সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে ‘মাদরাসায়ে কাদেরিয়া” হয়ে গেল।

বই:
তিনি কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের পন্ডিত ছিলেন। তার রচিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। এসব গ্রন্থের মধ্যে ফতহুল গায়ের গুনিয়াতুত তালেবীন, ফতহুর রবযানী, কালীদায়ে গাওসিয়া উল্লেখযোগ্য।

ইন্তেকাল:
হিজরী ৬৬২ সালের ১১ রবিউসসানী বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) পরলোক গমন করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। বড় পীর সাহেবের এই ওফাতের দিন সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন এবং তার মৃত্যুবার্ষিকী ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহাম হিসেবে পরিচিত।

( তথ্যসুত্র: উইকিপিডিয়া )