দ্বিধাবিভক্তির কারনে সাংবাদিকতার উন্নয়ন হচ্ছেনা -আলহাজ¦ এ কে এম মকছুদ আহমেদ

866

ডেক্স রিপোর্ট,পাহাড়ের আলো ডট কম : মফস্বল এবং গ্রামীণ এ নিয়ে অনেক তর্ক-বির্তক রয়েছে। আমি সেদিকে যাচ্ছিনা। মফস্বল আর গ্রামীণ যাই হউক সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বেহাল অবস্থা নিরসন না করলে অস্তিত্ত¡ টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই সকলে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা না করলে অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়বে। মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রেরিত খবরের উপর নির্ভর জাতীয় সংবাদপত্র এবং সংবাদপত্রগুলো টিকেও আছে।

কিন্তু মফস্বল সাংবাদিকদের কোন মূল্যায়নই নেই। হাতে গোনাদু-একটি পত্রিকা ছাড়া নিউজ এজেন্সীও ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন ভাতা দেন না। অথচ সর্বক্ষেত্রে ওয়েজ বোর্ডেই বাস্তবায়িত হয়েছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে। মিথ্যা সার্কুলেশন দেখিয়ে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন হার বাড়িয়ে নিয়ে দেদারসে তারা আয় করছে। অথচ তাদের খবর দ্বারা আজকে তারা বড় লোক অথবা বিরাট বিরাট ভবনের মালিক।

সেই মফস্বল বা গ্রামীণ সাংবাদিকরা এক বেলা খেয়ে না খেয়ে ছেলে সংসার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকই আবার জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। একটা অংশ অপসাংবাদিকতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তারা সমাজে ঘৃণার পাত্র হয়ে যাচ্ছে।

মফস্বলের সাংবাদিকদের জন্য যে ওয়েজ বোর্ড করা হয়েছে তা অত্যন্ত গণ্য হলেও বাস্তবায়ন করা হলে অভাব সৃষ্ট সংসারে মাথা গোঁজার ঠাঁই হতো। কিন্তু তা মোটেই মানা হচ্ছেনা। এমনকি অনেক বড় বড় পত্রিকা বিজ্ঞাপন বিলের কমিশনও ঠিক মত দেন না। দুই একটি পত্রিকা বেতন এবং বিজ্ঞাপনের কমিশন দিয়ে থাকেন।

বর্তমানে মফস্বলে সাংবাদিকদের রক্ষা করতে বা সুখ-দুঃখ দেখতে তেমন শক্তিশালী সংগঠনও নেই। পূর্বে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি মফস্বল সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

যার দৃষ্টান্ত রাঙ্গামাটির সুনীল কান্তি দে। তাঁর নিখোঁজের পর বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির দরদী বন্ধু তৎকালীন সভাপতি মুন্সীগঞ্জের সদি উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক গাইবান্দার সাংবাদিক গৌবিন্দ চন্দ্র দাশ, সিরাজগঞ্জের আমিনুল চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে নাম কাওয়াস্তে কয়েকটা সংগঠন রয়েছে তাদের কর্মকান্ড চোখেও পড়েনা। মফস্বলের সাংবাদিকদের স্বার্র্থ সংরক্ষণে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরিকরা দরকার।

জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকদের সংগঠনে দ্বিধাবিভক্তির কারনে জাতীয় ভাবে সাংবাদিকতার উন্নয়ন হচ্ছেনা। তার পরেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার সাংবাদিকরা অগ্রহণযোগ্য ওয়েজ বোর্ড দিয়ে অনেক ভাল জীবন যাপন করছে।

অনেক সুযোগ-সুবিধা আদায় করছে। শহরের আর গ্রামীণ সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক তফাৎ। এরকম মনে হয় কেন। গ্রামীণ বা মফস্বলের সাংবাদিকদের সাথে অনেক বৈষম্য। এই বৈষম্যের সমাধান করা না গেলে মফস্বল সাংবাদিকতা টিকে থাকবে কিনা জানিনা। মফস্বলের একজন সাংবাদিক মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করতে হিমশিম খেতে হয়। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের সাংবাদিক কেন পত্রিকা অফিসের একজন পিয়নও মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন।

ওয়েজ বোর্ড আন্দোলন কাদের জন্য? শুধু কি শহরের সাংবাদিকদের জন্য। মফস্বল সাংবাদিকদের সর্ম্পকে লিখে শেষ করা যাবে না। তবে মফস্বল সাংবাদিকদের রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।

মফস্বলের সংবাদপত্র : মফস্বলের সংবাদপত্রের অবস্থাতো সাংবাদিকদের চাইতে আরও করুন। যেটা নিয়ে কেউ উচ্চ বাচ্য করেনা। বিশেষ করে যারা কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক নয় তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যারা বিরোধ মনের ভাবাপন্ন তারাতো নিজের অস্তিত্ত¡কে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে না বললে ভুল হবে। তবে তারা ভয়ে ভয়ে থাকে। সরকার দলীয় সমর্থকদের তো পোয়াবারো। তারা মহা আনন্দে দিন কাটাচ্ছে।

এই সব কাহিনী লিখে শেষ করা যাবে না। তার পরেও কিছু কথা না বললেই নয়। ১৯৮২-১৯৮৭ এই পাঁচ বৎসর মফস্বল পত্রিকার দুর্ভোগ কমাতে এবং অভাব অভিযোগ নিরসনের লক্ষ্যে কক্সবাজারে সারা দেশের পত্রিকার সম্পাদক এবং মালিকদের এক সভায় বাংলাদেশ গ্রামীণ সংবাদপত্র পরিষদ নামে সর্বসম্মতি ক্রমে একটি সংগঠন সৃষ্টি করে আমাকে সভাপতি, ময়মনসিংহের হাবিবুর রহমান শেখ’কে সহ-সভাপতি এবং বগুড়ার অধ্যাপক আব্দুর রউফকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

উক্ত কমিটি পাঁচ বছর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কাজ করেছে। সারা দেশের প্রত্যেক জেলায় সফর করে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে অনেক কাজ করা হয়েছে এবং সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালানো হয়েছে। পাঁচ বছরের দিকে গিয়ে দেখা গেল যে গ্রামীণ সংবাদপত্র নামটা বাড়লে অনেক সমস্যার সম্মূখীন হতে হচ্ছিল। পরে একটি জরুরী সভায় সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে জাতীয় সংবাদপত্র পরিষদ রাখা হয়। আমার দায়িত্ব শেষে অন্যজনকে দায়িত্ব দিয়ে নতুন কমিটি করা হয়। ঐ সময়ে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করে।

তখন আমাদের অনেককে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদে রাখা হয়। দৈনিক আজাদীর তৎকালীন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেক, দৈনিক নয়া বাংলা’র সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-ছগীর, মোসলেম খাঁন, মঈন উদ্দীন কাদেরী শওকতসহ অনেক সম্পাদক এতে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিছুদিন পরে দৈনিক শক্তি সম্পাদক এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ নামে আরও একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। ঐখানেও আমাকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল।

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের আন্দোলনের মুখে সরকার একটি বেতন বোর্ড রোয়েদাদ গঠন করে তাদের ইচ্ছামত মজুরী নির্বাচন করে দেন, যা বাংলাদেশের কোন সংবাদপত্রই মানতে পারেননি। পরবর্তীতে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তখন ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের কারনে একতরফা রায়ে ওয়েজ বোর্ডের পক্ষে দিয়েছেন এবং তা আজও অব্যাহত।

সব সময় মালিক সাংবাদিকদের মধ্যে জটিলতা বেড়েই চলেছে। তাই উক্ত ওয়েজ বোর্ডটিকে গাঁজা খোর না বলে পারছিনা। কারণ আমি মালিক, আমি বেতন দেব। কিন্তু বেতন নির্ধারণে আমার কোন মতামত গ্রহণ যোগ্য নয়। এছাড়া এমন ভাবে পত্রিকার আয় নির্বাচন করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের কোন পত্রিকাই দিতে পারবেনা। ঢাকার তথাকথিত জাতীয় পত্রিকার সাথে বিভাগীয় শহরের এবং জেলা শহরের পত্রিকার আয় আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেক্ষেত্রে এই ওয়েজ বোর্ড গ্রহণ যোগ্য নয় এবং দেয়াও সম্ভব নয়।

যতদিন পর্যন্ত মফস্বল এবং বিভাগীয় ও জাতীয় পত্রিকার মালিক সাংবাদিক কর্মচারীদের মধ্যে সেইভাবে গ্রহণ যোগ্য সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবেনা। পত্রিকার সাথে টেলিভিশনের বেতন বোর্ড কোন ক্রমে এক করা যাবেনা। দৈনিক পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন এবং বেতন কোনদিন এক হতে পারেনা। বিজ্ঞাপন নীতিমালায় সংবাদপত্রের মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার সঠিক, সুষ্ঠ এবং গ্রহণযোগ্য নীতিমালা করা না হলে মফস্বলের পত্রিকা শেষ হয়ে যাবে।

বর্তমানে মফস্বলের পত্রিকায় কোন বিজ্ঞাপন দেওয়ার বিধান নাই। ২০০৫সন থেকে আমার ২টি পত্রিকা, ১টি বাংলা ও ১টি ইংরেজী পত্রিকায় পরপর ২দিন ১টি বিজ্ঞাপন দিতে হবে। ১/১১ এর সময় কিছুটা দাবী-দাওয়া এবং অনুনয়, বিনয় করে মফস্বলের জন্য অনুরূপ ১টি আইন করা হয়। কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয়া হয় সর্বশেষ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করলেই বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে।

যা কোন দিনই মফস্বলের কোন পত্রিকার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। তাই আইন পরিবর্তন করে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ঢাকার পত্রিকাই সকল প্রকার বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। এখানে তেলামাথায় তেল দেয়া হচ্ছে। একমাত্র বিজ্ঞাপন নীতিমালার কারণে মফস্বলের পাঁচ শতাধিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পত্রিকা তো ধুঁকে ধুঁকেই মরছে।

অন্যদিকে দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অখ্যাত-কুখ্যাত পত্রিকা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। যার কারণে গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞাপন নীতিমালা এবং ওয়েজ বোর্ড গঠন করে সংবাদপত্রকে বাঁচাতে হবে। যে গ্রামের আয়ের দ্বারা সারাদেশ চলে। সেখানে গ্রামের সংবাদপত্রগুলো কিন্তু দিনদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্রকে রক্ষায় সমস্যা সমাধানে সকলকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

(লেখকঃ- সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক গিরিদর্পণ, রাঙ্গামাটি, পার্বত্য জেলা)।