নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙ্গামাটি – ১৩ জুন রাঙ্গামাটির ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসের ২ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৭ সালের ১৩ জুন এই দিনে ভয়াবহ এই পাহাড় ধ্বসের ৪ সেনা কর্মকর্তাসহ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে ১২০ টি তাজা প্রাণ।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের একই দিন ১২ জুন পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় নানিয়ারচর উপজেলায় বড়পুল পাড়া ও ধর্মচান পাড়া ও হাতি মারায় একই পরিবারের ৫ জন সহ ১১ জন নিহত হয়েছে। বিভিষিকা ময় এই দিনটির কথা মনে পড়লে আজো ভয়ে আতংকে উঠে সাধারণ মানুষ। মা-বাবা, ভাই বোনসহ বহু আত্মীয় স্বজন হারিয়ে মানুষ নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছে। তার পরও সেই দিনটি সকলকে তাড়া করে ফিরে প্রতিনিয়ত।
রাঙ্গামাটি জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পাহাড় কাটা বন্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সাধারণ মানুষের মাঝে জনসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। সম্প্রতি রাঙ্গামাটি শহরের মহিলা কলেজ গেইট এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের মাটি কেটে বহুতল ভভন নির্মাণ করতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে ৩ শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে।
এর মধ্যে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটি শহরে ৪ সেনা সদস্যসহ ৬৫ জন, কাউখালী উপজেলায় ২৩ জন, কাপ্তাই উপজেলায় ১৮ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ৪ জন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জন মারা গেছে।
এর মধ্যে শিশু হচ্ছে ৩৩ জন, মহিলা ৩০ জন পুরুষ ৪২ জন। এর মধ্যে নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ২০ জন। আহত হয়েছে ৮২ জন। এর মধে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বেশ কয়েকজন চলে গেলেও ৩৯ জন রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
অপর দিকে ২০১৮ সালের ১২ জুন মধ্য রাতে ভারী বর্ষণের ফলে উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের বড়পুল পাড়া ৪ জন, ধর্মচানপাড়া ৪ জন এবং হাতিমারায় ২ জন, ঘিলাছড়িতে ১ জন পাহাড়ের মাটি চাপা পড়ে নিহত হয়েছে। একই দিনে রাঙ্গামাটি পৌর শহরের ২০ থেকে ২৫ টি স্থানে মাটি ধ্বসের ঘটনা ঘটলেও কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
পহেলা জুন ঘুর্ণিঝড় মোরা তান্ডব আর লংগদুর অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর ১৩ জুন ঘটে যায় রাঙ্গামাটির ইতিহাসের স্মরণকালে ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা। বিছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পুরো শহর। দেখা দেয় চরম মানবিক সংকট। পাহাড় ধ্বসের ৪দিনের মাথায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করে এবং রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম সড়কের ৮দিন সড়ক যোগাযোগ বিছিন্ন থাকার পর সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে মানিকছড়ি শালবন এলাকায় বিকল্প সড়ক চালু করে যোগাযোগ পূর্ণস্থাপিত হয়। ফলে স্বাভাবিক হয়ে আসে রাঙ্গামাটি জীবনযাত্রা।
১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড় ধ্বসে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষতি হয় রাঙ্গামাটিতে। পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় সেনা সদস্যসহ মারা যায় ১২০ জন। আর আহত হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশী। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে প্রায় আড়াই হাজারের মতো।
গত বছর পাহাড় ধ্বসের ফলে রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধ্বসের ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা দাঁড়িছে ৭২০ পরিবার। ক্ষতিগ্রস্থ ঘর বাড়ির মধ্যে রাঙ্গামাটি সদরে ৯০,কাউখালী-১৯০, নানিয়ারচর-৩০ বরকল-৭০, চিংমরং, ওয়াগ্গার রাইখালী ৩৪০ ক্ষতিগ্রস্থদের শুধুমাত্র কিছু ত্রাণ সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই পায়নি ক্ষতিগ্রস্থরা।
অন্যদিকে, রাঙ্গমাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৯ দিনের মাথায় শুরু হলেও দীর্ঘ ৬ মাস বন্ধ ছিলো রাঙ্গামাটি- কাপ্তাই সড়ক। এছাড়া ২০১৭ সালে ভারী বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক ধ্বসে গিয়ে দীর্ঘ ১ মাস পর চালু করতে পারলেও চালু হওয়ার ৪ দিনের মাথায় আবারো অতি বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়ক আবারো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বিভিষিকাময় এই দিনে রাঙ্গামাটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন ছিলো অনেক দিন। বাজারে জ্বালানি তেলের সংকট দিয়েছিলো। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘœ ঘটায় টেলিযোগাযোগ ব্যহত হচ্ছে। পানি ও বিদ্যুৎ সংকটে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের মাটি ভেঙ্গে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বর্ষণের ফলে রাঙ্গমাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এর শাল বন এলাকায় ১০০ মিটার রাস্তা ৩০ ফুট জায়গা পাহাড়ের নীচে তলিয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে ১০০ মিটার রাস্তা ৪০থেকে ৫০ ফুট গভীরে তলিয়ে গেছে।
রাঙ্গামাটির জন জীবন স্বাভাবিক করে রাখতে খাড়া পাহাড়ে পুনরায় কেটে বাইপাস করে সড়ক তৈরী করে সেনা বাহিনী ও সড়ক বিভাগের কর্মীরা। এছাড়া অভ্যন্তরীন রুটে রাজার হাট, লিচু বাগান, কারিগর পাড়া রাস্তার উপর পাহাড় ধ্বসে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিলো অনেক দিন।
এতো কিছুর পরও রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে প্রায় তিন মাস আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও প্রশাসনের আশ্বাসের কোন সুফল প্রায় ক্ষতিগ্রস্থরা। এর ফলে রাঙ্গামাটির সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ জন্মায়। অতীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্র আশ্রীতিদের বাসস্থনের আম্বাস দিলেও পরবর্তীতের কোন ধরনের সহযোগিতা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি তাদের জন্য। বর্তমানে কোন দূর্যোগ আসলে বর্তমানে আশ্রয় কেন্দ্র গুলোতে আসতে চায় না মানুষ। বিপদ মাথায় নিয়ে নিজের বসত ভিটায় পড়ে থাকতে চায় পাহাড়ের ঢালে বাসবাসকারী লোকজন।