নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙ্গামাটি – এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হ্রদে প্রায় বন্ধ হয় গেছে লঞ্চ চলাচল। কোন রকম লঞ্চ বা বোট চালানোর চেষ্টা করা হলে ও তা মাঝপথে গিয়ে চড়ে আটকে পড়ছে। এতে করে রাঙ্গামাটির ৬ উপজেলার যে সব জনগন কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ বা বোটে করে যাতায়াত করেন তারা পড়েছেন দূর্ভোগে। যাতায়াতে চরম সমস্যায় পড়েছেন ৬উপজেলার প্রায় ২ লক্ষ মানুষ।
গত কয়েকেদিন দুটি রুটে যাত্রী পরিবহন সেবা ঠিক থাকলেও গতকাল থেকে কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত ৬ টি উপজেলার সব কয়টিতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কাপ্তাই হ্রদের পান কমায় যাওয়ায় নৌপরিবহনসহ কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সংকট। কাপ্তাই হ্রদ কে ঘিরে অনেক গুলো সংস্থার টানা পোড়নে সংকট দিন দিন বাড়ছে পাচ্ছে। হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ও কমে গেছে। হ্রদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে জরুরী ভিত্তিতে কাপ্তাই হ্রদের ড্রেজিং এর দাবী জানিয়েছেন স্থাণীয় জনগন।
রাঙ্গামাটি কাপ্তাই হ্রদের রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার চেঙ্গী এবং লংগদু উপজেলার কাট্টলী বিল ছাড়া হ্রদের মূল ধারার সব জায়গাতে হ্রদের পানি কমে গিয়ে জেগে উঠেছে ডুবো চর। অনেক স্থানে পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া যায় হ্রদ। বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রী পরিবহন। উপজেলা সদর গুলোতে লঞ্চ পৌছাতে পারে না আরো অনেক দিন আগে থেকে। যাত্রী সেবার কাথা চিন্তা করে বর্তমানে ছোট ছোট ইঞ্চিন চালিত বোট দিয়ে যাত্রী পরিবহন সেবা দিচ্ছে রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি।
কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইড়ির বিস্তীর্ণ জলাভূমি শুকিয়ে এখন পরিণত হয়েছে মাঠ-প্রান্তরে। হ্রদজুড়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ ডুবোচর। বিভিন্ন অংশে জেগেছে চরাঞ্চল। হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলায় নৌ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম। ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে নৌযান এই কারণে নৌপরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে। ভোগান্তি পোহাচ্ছে উপজেলায় বসাবসকারী লাখো মানুষ।
হ্রদে অতিরিক্ত পানি কমায় কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদনে মারাত্মক ধস নেমেছে। ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রে বর্তমানে রেশনিং পদ্ধতিতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। হ্রদ দিয়ে বিভিন্ন রুটে বিঘ্ন ঘটছে নৌযান চলাচলে। হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় শহরে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়বে। হ্রদ থেকে পানি উত্তোলন ও সরবরাহ নিয়ে ঘাটতি দেখা দিবে আগামী কিছু দিনের মধ্যে।
এ বিষয়ে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এটিএম আবজ্জুর জাহের জানান, হ্রদে পানির স্তর এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে লেকে পানি রয়েছে ৮০.১৬ দশমিক থাকার কথা ছিলো ৮৩.৮০ এমএসএল (মীন সী লেভেল) বা ফুট। বর্তমানে কেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে রেশনিং পদ্ধতিতে ৩ টি ইউনিট দিয়ে ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় আরেকটি ইউনিট চালু করে রেশনিং পদ্ধতিতে উৎপাদন চালু রাখা হয়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলে জানান তিনি।
রাঙ্গামাটি নৌপরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দিন সেলিম জানান, কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় গত পরশু দিন দুটি উপজেলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া গতকাল থেকে সব কয়টি উপজেলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হ্রদের নাব্যতা কমে যাওয়ায় হ্রদের মুল চ্যানেল গুলো পালি জমে ভরাট হয়ে গেছে। সেই করণে গ্রীষ্মের শুরুতেই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে আমাদের। কষ্ট পাচ্ছে লাখো মানুষ। বর্তমানে লঞ্চসহ যানবাহন চলাচল করছে বিলাইছড়ি রুটে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার নিচে নতুনবাজার ঘাট, জুরাছড়ি রুটে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার নিচে সুবলং মিতিঙ্গ্যাছড়ি, বাঘাইছড়ি রুটে উপজেলার সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার নিচে লংগদু উপজেলার ফোরেরমুখ, নানিয়ারচর রুটে ১৫ কিলোমিটার নিচে বুড়িঘাট পর্যন্ত। এছাড়া বরকলের হরিণা রুটে লঞ্চ যাচ্ছে বরকল উপজেলা সদর পর্যন্ত।
বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর মোঃ মাহাবুবুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদের যে সকল লঞ্চ চলাচল করে সেই গুলো আমাদের রুট। আমরা লঞ্চ চলাচলে পারমিট দেই। এই লঞ্চ চলাচলে যে ব্যাঘাত সৃষ্ট হয়েছে তা খুবই দুঃখ জনক। তিনি বলেন, ১৯৬০ সালে বাঁধ দেয়ার পর থেকে এই হ্রদ ড্রেজিং করা হয়নি। তিনি বলেন, কাপ্তাই হ্রদটি সরকারের তার কারণে ড্রেজিং এর বিষয়ে আমরা কিছুই বলতে পারছি না। সরকার যদি আমাদেরকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার অনুমতি দেয় এবং আমাদেরকে বলে তাহলে আমরা ড্রেজিং এর চিন্তা ভাবনা করবো। তিনি বলেন, আমরা আরো একটি রুট নিয়ে ভাবছি এটা হচ্ছে ঠেগামুখ স্থল বন্দর বা ট্রানজিট এর জন্য যে পরিকল্পনা রয়েছে সেই রুটটি নিয়ে। সেই রুটে কি রকম লঞ্চ চলাচল করবে সেই ভাবে আমরা নতুন করে ভাববো।
উল্লেখ্য, কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে ১৯৬০ সালে খরস্রোতা কর্ণফুলি নদীর উপর দিয়ে নির্মিত হয় কাপ্তাই বাঁধ। সৃষ্টির পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন, নৌ যোগাযোগ, জলে ভাসা জমিতে কৃষি চাষাবাদ, সেচ, ব্যবহার্য পানি সরবরাহ, পর্যটনসহ বিভিন্ন সুযোগ ও সম্ভাবনা গড়ে ওঠে কাপ্তাই হ্রদ ঘিরে। কিন্তু সৃষ্টির পর গত ৫৯ বছরে কাপ্তাই হ্রদের কোনো সংস্কার, ড্রেজিং বা খনন করা হয়নি। ফলে বছরের পর বছর ধরে নামা পাহাড়ি ঢলে পলি জমে এবং নিক্ষেপ করা হাজার হাজার টন বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে হ্রদের তলদেশ। এতে নাব্যতার সংকটে অস্তিত্বের সম্মুখীন এই হ্রদ। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হ্রদ ঘিরে তৈরি হয় নানা সংকট।
জেলা প্রশাসক এ,কে,এম মামুনুর রশিদ বলেন, ‘হ্রদের ড্রেজিং না হওয়া পর্যন্ত সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। কাপ্তাই হ্রদের ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার জন্য আমরা বার বার উচ্চ পর্যায়ে চিঠি দিয়েছি। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিএর একটি প্রতিনিধি দল সার্ভে করে গেছে। তার পরও কেন এই কাজটি হচ্ছে না তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আগে বান্দরবানের নদী রক্ষা বিষয়ক মিটিং আমি বিষয়টি জানিয়েছি তারা বিষয়টি নোট করে নিয়েছে। তিনি বলেন, নাব্যতা সংকটে দিন দিন কাপ্তাই হ্রদ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে লঞ্চ চলাচলও বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরো একটি পত্র দিবো এবং রাঙ্গামাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ডাকাবো। আশাকরছি একটা সমাধান পাওয়া যাবে।