চাঙ্গা পাহাড়ের অর্থনীতি

1458

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পাহাড়। এটি প্রাকৃতিক সম্পদেও ভরপুর। এখানে পর্যটন এবং পাহাড়ি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্ভাবনা আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পর্যটনশিল্প। কিন্তু দুর্গম যোগাযোগ কাঠামোর কারণে ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পাহাড়ের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বান্দরবান থেকে আলাউদ্দিন শাহরিয়ার ও ঢাকার মোস্তফা তাহান

পর্যটন, জুমচাষ, তাঁতবস্ত্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে চাঙ্গা পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি। শীতেও অপরূপা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা পাহাড়গুলো দূর থেকে দেখে মনে হয় বরফের স্তূপ। প্রকৃতি যেন সবটুকু উজাড় করে দিয়ে পেখম মেলে বসে আছে সৌন্দর্য বিকাশে। যান্ত্রিক জীবনের নানা কর্মব্যস্ততার জীবনের ছক থেকে বেরিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ভিড় জমাচ্ছে ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা। চিরসবুজের ছোঁয়া পেতে পাহাড়ি জেলাগুলোয় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পর্যটকেরা। শীতের হিমেল পরশে সজীবতা এসেছে পাহাড়ের প্রকৃতিতে। আর ভ্রমণপিপাসু মানুষের আনা-গোনা বেড়ে যাওয়ায় চাঙ্গা হয়েছে পাহাড়ের অর্থনীতিও। পাহাড়ে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন এখানকার পাহাড়ি-বাঙালি মানুষের রুটি-রুজিও। শীতের সময় পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হস্তশিল্পের তৈরি শোপিজ, কোমর তাঁতের কাপড়সহ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাগুলোর বেচা-বিক্রিও জমে উঠে। পর্যটকবাহী গাড়িগুলোসহ পরিবহন ব্যবসাও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।ঢাকায় অনুষ্ঠিত পার্বত্য মেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের স্টলে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান অরুন কান্তি ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা পার্বত্য অঞ্চল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ থেকে যায়। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বয় করে পার্বত্যাঞ্চলের উন্নয়নের ধারাকে আরও গতিশীল করতে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী উপচিং মারমা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়ন তথা কৃষি, যাতায়াত, শিক্ষা, ক্রীড়া-সংস্কৃতি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প, সমাজকল্যাণ, বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নসহ আয়বর্ধনমূলক খাতে নিষ্ঠার সাথে বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে।

তিনি আরও জানান, বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নকল্পে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইসিটিভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত বেকার জনগোষ্ঠীকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের ওপরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবলে রূপান্তর করে আত্ম-কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করাই এর মূল লক্ষ্য।

পর্যটকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন বান্দরবানের অন্যতম পর্যটন স্পট নীলাচলের কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ে। মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র্রের লেকের স্বচ্ছ জলে, ঝুলন্ত সেতু আর ক্যাবল কারে। সাঙ্গু নদীতে ডিঙি নৌকায় চরে। আর মেঘ পাহাড়ের নীলগিরি, জীবননগর, চিম্বুক, ক্যাওক্রাডং চূড়ায়। অপরদিকে রাঙামাটি জেলার আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাই লেক, সাজেক ভ্যালি এবং খাগড়াছড়ির আলুটিলা সুরঙ্গর মতো দর্শনীয় স্থানগুলোয়। পাহাড়ে ভ্রমণের যাদের বেশি পছন্দ, তারা আজই বেরিয়ে পড়ুন পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্দেশে। শীতে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সড়কপথে বেড়াতে ভালো লাগবে এখন। এখানে রয়েছে বেড়ানোর মতো অনিন্দ সুন্দর অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।

আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির বান্দরবান জেলা সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, পর্যটনশিল্পের বিকাশে পাহাড়ের মন্দা অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আবাসিক হোটেলগুলোর সঙ্গে বান্দরবানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট এবং হস্তশিল্পের তৈরি শোপিজ, কোমর তাঁতের কাপড়ের দোকানসহ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। পর্যটকের আগমন বহুগুণে বেড়েছে বান্দরবান। জেলার প্রায় ৫০টি আবাসিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ এবং সরকারী রেস্টহাউসগুলোয় ৭-৮ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। ১৬ ডিসেম্বর থেকে থার্টিফার্স্ট নাইট পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটবে জেলায়।

খাগড়াছড়ি জেলা সাধারণ সম্পাদক অনন্ত ত্রিপুরা বলেন, জেলায় ২২টি বেসরকারি হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউজ ও কয়েকটি সরকারি রেস্টহাউস রয়েছে। এগুলোতে ধারণক্ষমতা দুই হাজারের মতো। কিন্তু প্রতিদিনই ৩-৪ হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন। পর্যটকের আগমন বাড়ছে প্রতিদিনই।

রাঙামাটি আবাসিক হোটেল সমিতির যুগ্ম সম্পাদক নেচার আহমেদ বলেন, রাঙামাটিতে ৪২টি আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি বেশ কয়েকটি রেস্টহাউজ আছে। সবগুলোতে ধারণক্ষমতা সাড়ে ৩ হাজারের মতো। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অধিকাংশই বুকিং রয়েছে। প্রতিদিনই ধারণক্ষমতার ৩-৪ গুণ বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে রাঙামাটিতে। এখানকার নিরাপত্তাব্যবস্থাও বর্তমানে পর্যটকবান্ধব।

রেস্টুুরেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি গিয়াস উদ্দিন বলেন, পর্যটকের ওপর এখানকার রেস্টুুরেন্টগুলোও অনেকটা নির্ভরশীল। পর্যটকের আগমন বৃদ্ধি পাওয়ায় রেস্টুরেন্টগুলোতে বেচা-বিক্রি বেড়েছে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ধরনের ব্যবসায় এখন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক বলেন, পাহাড়ের সম্ভাবনায় শিল্প হচ্ছে পর্যটন। এখানকার অর্থনীতির সঙ্গে পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত রয়েছে। পর্যটকনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য পাহাড়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পর্যটকদের আগমন বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকাও ঘুরতে থাকে। পার্বত্যাঞ্চলসহ সারাদেশেই পর্যটন শিল্পের বিকাশে কাজ করছে সরকার। পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরও স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।

সংবাদটি দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার সৌজন্যে প্রচারিত