ভালোবাসা আর মুগ্ধতার কাপ্তাই হ্রদ

706

পাড়ে আঁছড়ে পড়া ছোট ছোট ঢেউ, বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, পাড়ের কাছে গজিয়ে উঠা উদ্ভিদগুলোতে খাবারের খোঁজে আসা পাখির গুঞ্জন, এই তিনটির রসায়নে এক অদ্ভূত সুরের জন্ম দেয়। যেটি সবচেয়ে ভিন্ন, যেটি একমাত্র। এটি শুধুই পাওয়া যাবে কেবল কাপ্তাই হ্রদে। ভালোবাসার হ্রদে।
লাকড়ী বিক্রেতা সুমেধ চাকমার বুধবার দিনটি শুরু হয় সপ্তাহের অন্যবারগুলোর তুলনায় একেবারে ভিন্নভাবে এবং সবচে ব্যস্ততার সাথে। পাহাড় থেকে রক্ত জল করা পরিশ্রমে সংগৃহীত কাঠ নিজের ইঞ্জিন নৌকায় চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে রুটি-রুজির আশায়। কাপ্তাই হ্রদের বুক চিরে ছুটে চলে তার নৌকা। চোখে অনেকটা আশা, সাথে অনেকটা দুশ্চিন্তা ভেসে উঠে।
আসলেই কি, তার আশানুরূপ দামে বিক্রি করতে পারবে? হ্রদের বুকে ভাসতে ভাসতে সে একবার মনে করে নেয় সেই পাহাড়ে কাটানো সারা সপ্তাহ জুড়ে করা কঠোর পরিশ্রমের কথা। এমন নয় ছয় ভাবতে ভাবতে সে চলে আসে সদরের বনরূপা বাজার ও রিজার্ভ বাজার এলাকায়। তার অর্থ উপার্জনের একমাত্র ক্ষেত্রে।
জেলে কালাবাঁশি দাশ। ৭ জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ২০ বছর ধরে কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরছেন। রাতভর মাছ ধরেন, সকাল সকাল সে মাছ নিয়ে পৌঁছে যান শহরের রিজার্ভ বাজার বাজারে। নগ্ন পা শত ছিন্ন একটা শার্ট পড়ে একটি বড় গামলা নিয়ে সুবিধামতো একটি জায়গাতে বসে পড়ে সদাইয়ের উদ্দেশ্যে। মাছ বিক্রি করতে করতে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বুলিয়ে নেন কাপ্তাই হ্রদের দিকে। মনে মনে ধন্যবাদ জানায় ভালোবাসার হ্রদকে। এই হ্রদ না থাকলে তাকে কতো আগেই ভেসে যেতে হতো। তারই গোষ্ঠী শত শত বছর ধরে এই ব্যবসা করে আসছে। এই হ্রদের কারণেই সে তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে। পরিবারে ভরণ-পোষণ চালিয়ে নিতে পারছে আর পরবর্তী প্রজন্মকে পৌঁছিয়ে দিতে চেষ্টা করছে উন্নত একটি জীবনে।
জুম চাষী মালতী চাকমা। ৫ বছর আগে কোন এক পাহাড়ী সাপের দংশনে স্বামী হারান তিনি। কাঁধে চলে আসে ছোট ছোট দুটি সন্তানের দায়িত্ব। সম্বল একমাত্র স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসা। সপ্তাহ জুড়ে ফলানো ফসল নিয়ে শনি ও বুধবার সদরের রিজার্ভ বাজারে চলে আসে কিছুটা ভালো দাম পাওয়ার আশায়। তার চলাচলের একমাত্র মাধ্যম কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদে ভেসে আসতে আসতে তার ভাবনা জুড়ে থাকে তার সন্তান দুটির কথা। বড় মেয়েটি পড়ালেখায় ভালো, এইবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। ফলাফল ভালো হলে সদরের কোন একটি ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবে। এখানে রেখে পড়াশোনা করাবে; তার এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে কাপ্তাইয়ের এই নাব্যতার জন্য। এই ভালোবাসার হ্রদের কারণেই।
এমনও হাজারো দু:খ শোকের গাঁথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই ৭২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা এই হ্রদের প্রতিটি কোণায় কোণায়।
এই হ্রদের চোখ ধাঁধানো অপরূপ সৌন্দর্য্যরে মোহে বিভোর হয়ে থাকে দেশ-বিদেশ থেকে ঘুরতে আসা হাজার হাজার পর্যটক। কি অপরূপ মমতায় পাহাড়গুলো যেন আঁকড়ে আছে এই হ্রদকে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত যেন এক মোহনী গাম্ভীর্যতায় বয়ে চলে ভালোবাসার হ্রদ। তীরের পাড়ে গড়ে উঠা জনবসতিগুলোকে নিজের সন্তানের মতো করে লালন পালনে ব্যস্ত যেন এই বিশাল জলরাশি। নীল নীল জলের মধ্যে যেন ফুটে উঠে এখানকার মানুষ, গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। চোখ বন্ধ করে একটু মনোনিবেশ করে নদীর কলকল ধ্বনি শুনে মনে হয় যেন এই জনপদের মানুষের দু:খ সুখের গল্পগাঁথা।
এভাবেই মহাকালের চোখে ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন বয়ে যাচ্ছে রাঙামাটিবাসির মাতৃসম হ্রদ, ভালোবাসার হ্রদ। ইচ্ছে, যেখানে আমৃত্যু ভালোবেসে কাটাবে জীবন।
News copy of pahar24.com