কোন একদিন পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের জন্ম ভিটায়

15

॥ ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই ॥
আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরে, ফুল তুলিতে যাই, ফুলের মালা গলায় দিয়ে, মামার বাড়ি যাই। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ, পাকা জামের মধুর রসে, রঙিন করি মুখ। মামার বাড়ি নামে এই কবিতা ছোট বেলায় কম বেশী আমরা পড়েছি।
এছাড়া ” এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে” “কবর” নামে অমর সৃষ্টি এই কবিতার স্রষ্টা পল্লী কবি জসিম উদ্দীন।
আবার আসমানী কবিতার সেই প্রথম বিখ্যাত লাইন” আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। এই সব কালজয়ী বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টির কারিগর গ্রাম বাংলার কবি জসিম উদ্দীন।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) বর্ষাস্নাত এক বিকেলে কবির জন্ম ভিটায় ফরিদপুর জেলা শহরে অদূরে অম্বিকাপুরে যাই, যদিও তিনি ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী তাম্বুলখানা গ্রামে মাতা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট এর জন্ম ভিটায় জন্ম নিলেও তাঁর বাবা আনসার উদ্দিন মোল্লার বাড়ি ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী গোবিন্দপুর বর্তমান নাম অম্বিকাপুরে গ্রামে।
বন্ধের দিন না হওয়ায় সেদিন দর্শনার্থীর সংখ্যা হাতেগুনা কয়েকজন। ডুকতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়ে গেল কবির কবর এবং তাঁর পাশে কবির সহধর্মিণী মমতাজ জসিমউদদীন মনিমালার কবর। কবির কবরের পেছনে ইতিহাসের মতো সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই অমর কবিতা “কবর” এর ডালিম গাছটি।
আরো ভেতরে ডুকতেই চোখে পড়েছে কবির বসতবাড়ি, যেই ঘরের দরজায় লেখা আছে ১৯৩৯ সালে কবির সাথে মমতাজ বেগম মনিমালার বিয়ে হয়, বাসর রাতে এই স্থান দিয়ে চোরের দল কবি পত্নীর গহনা চুরি করে নিয়ে যায়। এছাড়া চোখে পড়ে কবির পিতা মাতা এবং ছোট ও বড় ভাই এর থাকার ঘর। কবিপুত্র হাসু ও বাঁশুকে নিয়ে কবির হাতের লেখা চিঠি। কবি আঙ্গিনায় দেখা মিলল একটি টেঁকি ঘর। যে টেঁকি দিয়ে কবির মা চাউলের গুড়া আর গুড় দিয়ে তাদেরকে পিঠা তৈরি খাওয়াতো। আর এই টেঁকি ঘরের বাহিরের কবি লিখেছেন “আমাদের গরীব-সংসারে ঘি ময়দা ছানা দিয়া জৌলুস পিঠা তৈরি উপকরণ মায়ের ছিল না। চাউলের গুড়া আর গুড় এই মাত্র মায়ের সম্পদ।
এছাড়া কবির আঙ্গিনার বিভিন্ন ঘরে দেখা মিললো কবির বিদেশ ভ্রমনের ছবি, বিশিষ্ট জনদের সাথে ছবি এবং তাঁর লেখা, কবিতা, গান আর কাব্যগ্রন্থের অংশ বিশেষ। কবির গৃহ হতে বের হয়ে দেখা মিললো কুমার নদ। যে নদের পাড়ে কবির কেটেছে শৈশবের দিনগুলো।
এদিন (১ জুলাই) কবির বাড়ির গেইট দিয়ে ডুকতেই দেখা পাই অম্বিকাপুরের ষাট বছরের আবু তালেব বেপারিকে। তিনি জানান, কবি ঢাকা থাকতো তাই তিনি কবিকে দেখেন নাই, এখানে জানুয়ারি মাসে মেলা বসে প্রচুর লোক আসে।
এসময় কবির স্মৃতিশালায় দেখা হয় ফরিদপুরে কর্মরত একটি ঔষধ কোম্পানি এরিয়া ম্যানেজার সাহিত্যপ্রেমী বিপ্লব দাশের সাথে। তিনি বলেন, কবি জসিম উদ্দীনের বাড়ির সামনে থেকে কোন এক সময় বড় পদ্মা নদী প্রবাহিত হতো, কবির বাড়ির বাঁশ বাগানের ছায়ার নীচে কবি নজরুলকে পাটি পাতিয়ে বসার জন্য দেন। সাথে সাথে আধা ঘণ্টার মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামকে উদ্যোশ করে পল্লী কবি লিখে পেলেন “আকাশেতে এক কোনেতে একাদশীর চাঁদ” কবিতাটি। যেটি পরবর্তী তাঁর নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। এছাড়া এখানে তিনি লিখেছেন তাঁর কবর কবিতাটি।
এসময় দেখা হয় স্থানীয় কবি ও সাহিত্যিক রফিকুল আজিজের সাথে, তিনি বলেন পল্লী কবি জসিম উদ্দীন আমাদের প্রাণের কবি, তাঁর কবিতা আমাদেরকে আন্দোলিত করতো, তাঁর কবর কবিতা পড়ে পড়ে আমরা বড় হয়েছি, তাঁর কাব্যগ্রন্থ সোজন বাদিয়ার ঘাঁট, নকশী কাঁথার মাঠ আমাদেরকে সেই সময়ে খুবই টেনেছে, বলতে গেলে এখনো একাত্ম হয়ে যাই কবির সাথে। বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে একমাত্র কবি জসিম উদ্দীন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর বাড়ির অন্দরমহলে কবির আনাগোনা ছিল।
কবির বাড়ি দেখতে আসা দর্শনার্থী ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী প্রেমানন্দ বালা বলেন, এখানকার পরিবেশ দেখলেই বুঝা যায় কেন তিনি পল্লী কবি।
কথা হয় কবির বাড়ির টিকিট কাউন্টারের দায়িত্ব পালন করা বৃষ্টি আক্তার এর সাথে, তিনি বলেন, এখানে শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিন প্রচুর দর্শনার্থী হয়। গড়ে ২ শত হতে আড়াইশত কবিপ্রেমী মানুষ আসে এখানে। জানুয়ারী মাসের ১ তারিখে মেলা বসে, যা মাসব্যাপী চলে।