॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
দেশের বিভিন্ন জায়গায় দূর্গাপূজাকে সামনে রেখে প্রতিমা ভাংচুরসহ দূর্গাপুজোর তীব্র বিরোধীতা করে হুমকির প্রতিবাদে এবং ৯ দফা দাবী বাস্তবায়নে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূর এর বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখা।
রবিবার (৬ অক্টোবর) সকালে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খানের কাছে এই স্মারকলিপি প্রদান করেন রাঙ্গামাটির নেতৃবৃন্দরা।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি শিক্ষক অরূপ কুমার মুৎসুদ্দী, সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদারসহ বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও সদস্যরা।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল সফলতার পর গত ৫ আগস্ট থেকে সারা দেশ জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে ও চলমান ছিলো তা বর্তমানে আগের তুলনায় ক্রমশহ্রাসমান হলেও তার চূড়ান্ত অবসান এখনো হয়নি। ইতোমধ্যে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজোকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা ভাংচুরের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানীও চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ‘ইনসাফ কায়েমকারী ছাত্র-জনতা’ নামে এক কথিত সংগঠন সর্বজনীন দুর্গাপূজোর তীব্র বিরোধীতা করে পূজার্থীদের হুমকি সম্বলিত ১৬ দফা দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারত বিরোধীতার নামে হিন্দু বিরোধীতাকে এক বিশেষ মহল তাদের রাজনীতির উপজীব্য করে তুলেছে। যদিও সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
গত ৪ আগস্ট, ২০২৪ থেকে ২০ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে মোট ১৭ দিনে দেশের ৬৮টি জেলা ও মহানগরে সর্বমোট ২০১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ৩৪টি আদিবাসী পরিবারসহ ১৭০৫টি পরিবারের সদস্যরা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৭টি পরিবার সব হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। উল্লেখিত এই ১৭ দিনের সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৯জন, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে, নারী নির্যাতন/ধর্ষণ/গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪টি, যার মধ্যে ১জন বাকপ্রতিবন্ধী। ৯১৫টি বাড়িঘরে ও ৯৫৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, বসতবাড়ি এবং জমি/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল হয়েছে ২২টি। পার্বত্য চট্টগ্রামের দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর/২৪ তারিখ যে জাতিগত সহিংসতা চলেছে তাতে অন্তত ৪জন নিহত হয়েছে, ২টি ধর্মীয় উপসনালয়সহ অসংখ্য ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট, ভাঙচুড়, অগ্নিসংযোগে ধ্বংস হয়েছে এবং যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ১৩ আগস্ট, ২০২৪ যমুনা অতিথি ভবনে অনুষ্ঠিত সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের সাথে আপনারই আহবানে মতবিনিময় বৈঠকে যোগদান করেছিলেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে তিনি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে অনতিবিলম্বে ৪ (চার) দফা করণীয় এবং সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রনালয় গঠনসহ ৮ (আট) দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনে ৬টি প্রস্তাবনাও তিনি আপনার সামনে তুলে ধরেছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে আপনার বরাবরে আমাদের আকুল আবেদন-১) সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত পরিবারকে এবং আহতদের চিকিৎসার জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হউক, ২) ক্ষতিগ্রস্ত উপাসনালয়সমূহের পুনসংস্কার বা পুননির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানপূর্বক পূণর্বাসন করা হউক; ৩) সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানীদাতা ও সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ব্যক্তিদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে শাভিতর ব্যবস্থা করা হউক; ৪) দেশব্যাপী আসন্ন শারদীয় দুর্গাপুজো শাস্ত্রীয় পরিবেশে অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হউক, ৫) সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রনালয় গঠনসহ ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮ (আট) দফা দাবি বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হউক; ৬) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নেতা এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে ঢাকার যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর ধানায় রুজুকৃত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানীমূলক মামলা দুটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হউক; ৭) ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর/২৪ তারিখে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ধর্মীয় উপসনালয়ে হামলাসহ সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার বিচারবিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দোষীব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হোক। নিহত ও আহত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপুরণ প্রদান করা হোক। ৮) পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ তিন পার্বত্য জেলায় জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ সংখ্যালঘু তথা সনাতনী (হিন্দু) সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ৯) সারা দেশব্যাপী বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত উদ্দেশ্যমূলক ও হয়রানীমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হউক।
আমরা চাই আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতী সরকারের আমলে বাংলাদশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালগুরা উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও শঙ্কামুক্ত হয়ে শান্তিতে, সম্প্রীতিতে, নির্বিঘ্নে বসবাস যাতে করতে পারি। বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আপনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আমরা আন্তরিক থেকে আপনার সাথে একত্রে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।