রামু বৌদ্ধবিহার ও পল্লীতে হামলার একযুগঃ সাক্ষীর অভাবে শেষ হয়নি বিচার, এখনো কাটেনি শঙ্কা

12

॥ কক্সবাজার সংবাদদাতা ॥
কক্সবাজারের রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট আর অগ্নি সংযোগের একযুগ পার হচ্ছে রবিবার (২৯ সেপ্টেম্বর)। এসব ঘটনায় পৃথক দেড় ডজন মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে ১২ বছরেও শেষ করা যায়নি বিচার প্রক্রিয়া। অভিযুক্তরা জামিনে এসে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে এখনো শঙ্কা ও আতংক কাটেনি এ সম্প্রদায়ের, এমনটি দাবি সংশ্লিষ্টদের।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন মজবুত রাখতে বিচার নিষ্পত্তির চেষ্টা চললেও সাক্ষীর অভাবে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে না বলে স্বীকার করেছেন সরকারি আইনজীবী (পিপি) সৈয়দ রেজাউর রহমান।
এদিকে, রামু ট্র্যাজেডির ঘটনায় মূল অভিযুক্তদের সনাক্ত ও বিচার নিশ্চিতের দাবিতে রামু চেরাংঘরস্থ মৈত্রী বিহারে (লালচিং-সাদাচিং) কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ পরিষদের আয়োজনে একযুগ পূরণের দিন ‘সংঘদান’ করা হবে। আর বিকেলে শান্তি র‌্যালির আয়োজন করেছে বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ পরিষদের আয়োজনে দুপুরে বিশ্ব শান্তি কামনায় ‘সংঘদান’ অনুষ্ঠিত হবে। এরপরে বিকেল তিনটায় বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের আয়োজনে কেন্দ্রীয় সীমা বিহার থেকে শান্তি র‌্যালি রেব হয়ে প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বাইপাস হয়ে সীমাবিহারে এসে শেষ হবে। যেখানে জেলার টেকনাফ, উখিয়া এবং চকরিয়া থেকে সম্প্রদায়ের লোকজন অংশ নিবেন।
তথ্যমতে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবক পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছে এমন গুজবের জেরে রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার এবং বৌদ্ধপল্লির ২৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার জের ধরে পরদিন উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। মামলায় ৩৭৫ জনের নাম উল্লেখসহ আসামী করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। পরে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হলেও ১৮ মামলায় ৯৯৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে চার্জ গঠনের পর সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষী দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। এদিকে ঘটনার পর থেকে আজও খোঁজ মেলেনি উত্তম বড়ুয়া নামের ঐ যুবকের।
উত্তমের বাবা সুদত্ত বড়ুয়া ও মা মাধু বড়ুয়া বলেন, ঘটনার পর থেকে উত্তম কোথায় আছেন তা জানেন না তারা। অপেক্ষায় আছেন ছেলে একদিন ফিরে আসবেন।
স্থানীয়রা বলছেন, হামলার কয়েক বছর পর এলাকায় আবারও সকল সম্প্রদায়ের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠে। দৃষ্টিনন্দন ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে পুড়ে যাওয়া বিহারগুলো। তাই, নতুন করে সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার ভয়ে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করছে, ন্যক্কারজনক এ ঘটনা কেন ঘটেছিল, নেপথ্য কারণ একযুগেও উন্মোচিত হয়নি। সেদিন হামলায় চেনা-অচেনা অনেকেই অংশ নিয়েছিল। বিভিন্ন স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং তদন্ত প্রতিবেদনেও তার প্রমাণ মিলেছে।
রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়ুয়া বলেন, হামলার ভিডিওতে যাদের দেখা গিয়েছে তাদের অনেককে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আবার হামলায় জড়িত নেই এমন অনেকে আসামী হয়েছেন। তাই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। সাক্ষীরা পরিবার নিয়ে বাস করেন, তাদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তাও রয়েছে।
রামু কেন্দ্রীয় জাহাজ ভাসা ও প্রবারণা উদযাপন পরিষদ সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথাম বলেন, আমরা এখনো হামলার শংকামুক্ত নয়। আমাদের প্রত্যাশা ২০১২ সালের সেই ঘটনা আর পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। তাই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।
রামুর বাসিন্দা সাজু বড়ুয়া বলেন, ওই ঘটনায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনের পরিবর্তে মামলার বাদী হয়েছে পুলিশ, তদন্তও করেছে পুলিশ। এতে ইচ্ছে মতো আসামি করে অভিযোগপত্র থেকে বাদও দিয়েছে। যার ফলে নিরাপত্তা জনিত কারণ ও প্রকৃত আসামীদের অনেকে আড়াল হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) সৈয়দ রেজাউর রহমান রেজা বলেন, আমি পিপি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি ৩ মাস হবে। ইতিমধ্যে আমি সকল অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপিদের নিয়ে বসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে সকলকে আন্তরিক হতে অনুরোধ করেছি। বৌদ্ধ মন্দিরে মামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও আলোচিত ১৮টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন আসামি ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। আমরা চেষ্টা করছি তথ্য প্রমাণ আর সাক্ষীর মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতি বিচার প্রক্রিয়া এক প্রকার থমকে আছে।
তিনি আরও বলেন, সাক্ষীদের নামে সমন জারি করা হয়েছে অনেকবার। কয়েকটি মামলায় সাক্ষী চলমান থাকলেও সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন সাক্ষীরা। তিনটির মতো মামলা পুন:তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়েছে। আলোচিত এসব মামলা নিষ্পত্তিতে আমাদের আন্তরিকতার কমতি নেই। সাক্ষীরা আদালতে আসলে প্রয়োজনে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন পিপি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেসময় তদন্ত কর্মকর্তারা রাজনৈতিক দলের প্রভাবের বাইরে গিয়ে বিচক্ষণতা ও পেশাদারিত্বের সাথে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে বলে মনেকরি। তাছাড়াও সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা এবং নতুন করে আবার কোন সংঘাত যাতে না হয় সে কারণে অনেকে সাক্ষী দিতে অনীহা প্রকাশ করছে বলে মনে হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ চাই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি মাধ্যমে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হউক।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ শীল প্রিয় মহাথের বলেন, রামুর ধর্মীয় সম্প্রীতি শত বছরের। দীর্ঘ বছরের ঐতিহ্যে নিমিষেই শেষ হয়। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা স্মরণ হলে চোখে জল চলে আসে। একযুগ পার হলেও আমরা জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে পায়নি। ভিডিও ও ছবি দেখে নিরপরাধ থাকলে তাদের নয় প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তবে, আমরা পুরনো সম্প্রীতির বন্ধনে আবারো আবদ্ধ হয়েছি।