রাঙ্গামাটির বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস শুকুরের পিতা গুনী নৃত্য শিল্পী মরহুম দেলওয়ার হোসেনের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

62

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
রাঙ্গামাটির বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস শুকুরের পিতা পার্বত্য অঞ্চলের কিংবদন্তী পুরুষ পাহাড়ি উপজাতীয় নৃত্যের পথিকৃত গুনী সংস্কৃতি শিল্পী মরহুম দেলওয়ার হোসেনের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী গতকাল পালিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গতকাল মরহুম দেলওয়ার হোসেনের ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কবর জেয়ারত, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। রাঙ্গামাটি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অবদান চিরস্মরনীয় হয়ে আছে। পার্বত্য অঞ্চলের কিংবদন্তী এ গুণী পুরুষ ছিলেন পাহাড়ি উপজাতীয় নৃত্যের পথিকৃত। এ গুনী শিল্পী শুধু উচ্চাঙ্গ ও লোকনৃত্যে দক্ষ ছিলেন না, তিনি নৃত্যের পাশাপাশি তবলা, এস্রাজ, বেহালা, সেতার ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন সমান দক্ষতার সাথে। পার্বত্য অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ছিল তার অসাধারণ অবদান।
তার জীবনী থেকে জানা যায়. তিনি ছিলেন একজন যশস্বী শিল্পী । তাঁর পিতা ভাল বেহেলা বাজাতেন, পিতারগুণাধিকারী হলেও নিছক কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই তিনি নৃত্য শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছিলেন। তখন ১০/১২ বছর বয়স।
প্রথমেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের আসামে চলে যান। জীবনের শুরুতে কৈশোর, যৌবনে তিনি আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুরী, সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক তাদের আচার ব্যবহার, জীবনধারার সংস্পর্শের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু যে আশায় তিনি ঘর ছেলেছিলেন তাৎক্ষনিকভাবে তার কোন ব্যবস্থা হয়নি। ফলতঃ দু’টাকা বেতনে এক দোকানে বাবুর্চির চাকুরি নিলেন। আরো কিছু দিন গেলো, আশার শেষ নেই, প্রচেষ্ঠার অন্ত নেই, ধৈর্য্যের কমতি নেই। অবশেষে তিনি পরিচিত হলেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক রাম সিং এর সাথে। তাঁর হাতেই প্রথম নৃত্য শিক্ষার শুরু। কিন্তু নৃত্য শিক্ষায় ডুবে যাবার প্রাক মূহুর্তে আকুণ্ঠ ডুবে গেলেন প্রেমের অমিয় সাগরে। আসাম অয়েল কোম্পানীর ম্যানেজারের দ্বাদশ বর্ষীয়া সুন্দরী চটপটে কন্যা ভার্ণার অজান্তেই ভালবেসে ফেললেন। কিন্তু কীভাবে কথাটা বলা যায়? একদিন অপেক্ষার দুঃসহ মর্মজ্বালাকে তুলে ধরলেন ভার্ণার কাছে। জবাবে ভার্ণা বললেন ণবং ঝযব ফড়বং. ভার্ণার অকৃত্রিম ভালবাসা তাঁর সাধনাকে গতি দিল। তাঁর শিল্প সত্তার মর্মসুপ্ত আগুনকে আরো শতগুন বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ভাগার বাবা তাদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে রেগে টং, গুলি করে মেরে ফেলবেন দেলওয়ারকে। কিন্তু ভার্ণার ভালবাসা তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। ভার্ণার সাথে তিনি আমেরিকা চলে যান ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে। সেখানেই তাঁদের বিয়ে হয়। এদেশ থেকে সকল লেনদেন শেষ করে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেবার আশায় শেষবারের মত দেশে এলেন ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে, তাঁর আর আমেরিকা ফিরে যাওয়া হল না। তিনি আসার ক’দিন পর নরিনের জন্ম হয়। ১৯৫০ সালে ভার্ণার মৃত্যু হয়। দেশে আসার পর সুরত জামালের সাথে তাঁর বিয়ে হয় এবং নৃত্য শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন গভীরভাবে, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ভাগো আর্ট সেন্টারের ছত্রছায়ায় শ্রদ্ধেয় গওহর জামিল, জি.এ. মান্নান ও দেবু ভট্টাচার্য্যের কাছে লোকনৃত্য ও উচ্চাঙ্গ নৃত্য শিক্ষা করেন, পাকিস্তানের খ্যাতনামা চিত্রাভিনেত্রী ও নৃত্য শিল্পী কাফেরার কাছেও তিনি নৃত্য শিক্ষা করেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নৃত্য পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। জীবন সংগ্রামের শুরুতে আসাম, মনিপুরী, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় সংমিশ্রনে যেতে পেরেছিলেন বলে, হয়ত বিধাতার নির্দেশেই তাঁকে আবারো এই পার্বত্য উপত্যকায় জনগোষ্ঠীর কাছে ফিরে আসতে হয়েছে এবং ১৯৬৩ সালে তিনি পার্বত্য জেলা বোর্ডে নৃত্য শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন এবং তৎকালীন পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলে নৃত্য শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, মনোঘর উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট ট্রিজার স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব ও নিষ্ঠার সহিত নৃত্য শিক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজাল ঠেলে স্থানীয় নৃত্য শিল্পী সৃষ্টিতে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। আজকের পার্বত্য এলাকার চাকমা উপজাতির ঐতিহ্যবাহী জুম নৃত্য, শিকারী নৃত্য, মুরং সম্প্রদায়ের গরু শিকারী নৃত্য, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বোতল নৃত্য, গড়াইয়া নৃত্য, মারমা সম্প্রদায়ের বাঁশ নৃত্য তাঁরই হাতে কম্পোজ করা এবং সেই থেকে তিনি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন। এই সৃষ্টিশীল যশ্বস্বী শিল্পীর ভাব-ভঙ্গী, আচার-আচরণ চলাফেরা দেখে পার্বত্য অঞ্চলের সকল সম্প্রদায়ের কাছে ও তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ শুনী মান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল? দেলওয়ার আসলে কোন সম্প্রদায়ের লোক। তখন থেকেই তিনি পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতি জগতে নৃত্যের জন্য আমৃত্যু কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনন্য। নৃত্য শিক্ষক হিসেবে তো বটেই। এ শুনীজন শিল্পী নৃত্যের পাশাপাশি সংগীতেও পারদর্শী ছিলেন।
করাচী, লাহোর, পাঞ্জাবে ও সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করতে গিয়ে, পাকিস্তানে খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী ফরিদা খানম ও নূরজাহানের সাথে ভাল বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। সে সুবাদে তিনি গানের তালিম নেন। নৃত্য পরিবেশন শেষে, বিখ্যাত গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, গোলাম আলী ও নুরজাহানের গান শুনিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মন আকৃষ্ট করতেন।
এ গুনীজন শিল্পী শুধু উচ্চাঙ্গ ও লোকনৃত্যে দক্ষ ছিলেন না, তিনি নৃত্যের পাশাপাশি তবলা, এস্রাজ, বেহালা, সেতার ও হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন সমান দক্ষতার সাথে। ১৯৭৯ সালের ২৭শে এপ্রিল নৃত্য এবং যন্ত্র সংগীতে দক্ষতার জন্য রাঙ্গামাটি প্রকল্পনা সাহিত্যঙ্গন থেকে তাঁকে গুনীজন হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে ও কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় ২৫শে আগষ্ট’৮১ থেকে ২৭ শে আগষ্ট ৮১ পর্যন্ত কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী চট্টগ্রাম বিভাগীয় সংগীত সম্মেলনে সাফল্যজনক অংশগ্রহণ করার জন্য দেলওয়ার হোসেনকে পুরস্কার ও প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়।
২০০১ সালে ১৬ই জুন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও মরনোত্তর সম্মাননা পদকে ভূষিত করেন।
কাল গড়িয়ে চলে, একটি জাতির সাংস্কৃতিক মূল্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে ইতিহাস, তেমনি ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মাঝে বেঁচে থাকে একটি জাতিসত্ত্বা। এই সৃষ্টিশীল-যশস্বী শিল্পী, মরহুম দেলওয়ার হোসেনের রেখে যাওয়া শিল্পী-সত্ত্বা এই পার্বত্য উপত্যকায় চিরদিন অমর হয়ে আছে ।
তাঁর মরহুম পিতা হাজী আমজু মিয়া ফকিরের সাত ছেলে ও সাত মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তাঁর ছয় ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস শুকুর ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে শহীদ হন।
এ গুনীজন শিল্পীর সাদা হাফ শার্ট ও পাজামা তাঁর আনুষ্ঠানিক পরিচ্ছদ। অন্য সময় লুঙ্গি, শার্ট। সদাহাস্যময়। ৫ম শ্রেণীতে মাত্র দু’দিন ক্লাস করেও নির্ভুল ইংরেজীতে কথা বলতে পারতেন। তিনি ১৯৯৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লায় নিজ পুত্রের কর্মস্থলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।