ভয়, শঙ্কা ও উত্তেজনা মধ্যদিয়ে রাত পেরুলেই রাঙ্গামাটির তিন উপজেলায় নির্বাচন

181

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাঙ্গামাটিঃ-কাল ভোর হলেই দ্বিতীয় দফায় রাঙ্গামাটির ৩টি ইউনিয়নের নির্বাচন শুরু। পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের চাপ, দলীয় চাপ, বিদ্রোহী প্রার্থীসহ বিভিন্ন ভয় ও সংখ্যা নিয়ে ভোটারা তাদের যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেবে। রাঙ্গামাটির ৩টি উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে মোট চেয়ারম্যান প্রার্থীর সংখ্যা ৩০জন।
ইতিমধ্যে মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) রাত ১২টার পর থেকে প্রচারণা শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু ভোট গ্রহণের পালা। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি ও বরকল উপজেলায় ভোটারা তাদের যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেয়ার সুযোগ কতোটুকু পাবে তা দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগ সংবাদ সম্মেলনে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো হুমকী ধমকী ও অস্ত্রের মহড়ার কথা তুলে সংবাদ সম্মেলন করে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপনের দাবী জনিয়েছে আওয়ামীলীগ।
এবারের ইউপি নির্বাচনে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি কোন প্রার্থী না দিলেও আঞ্চলিক দলের সাথে যোগাযোগ করা স্বতন্ত্র প্রার্থীকে তাদের প্রার্থী হিসাবে নিয়ে পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে কেউ মুখ না খুললেও তাদের মনের মধ্যে বিভিন্ন সময় ভয়ভীতির যে শঙ্কা তা ফুটে উঠছে।
এদিকে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে রাঙ্গামাটির প্রতিটি উপজেলায় ভোট কেন্দ্র ও বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন দাবী জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে। খাদ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার সংবাদ সম্মেলনে এ দাবী জানান।
এদিকে, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার ২নং রাইখালী, ৪নং কাপ্তাই এবং ৫নং ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই তিন ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ৭ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ২৩ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৮ জন প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। আর তিনটি ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ৯৬ হাজার ৭শত ৮১ জন। আর ২৭টি ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর মধ্যে কাপ্তাইয়ে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন-কাপ্তাই সদর ইউনিয়নে আবদুল লতিফ (আওয়ামী লীগ) ও তার দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন পাটোয়ারি বাদল (স্বতন্ত্র)। মহিউদ্দিন পাটোয়ারি ইউপি সদস্য সজিবুর রহমান হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় বর্তমানে পলাতক বলে জানা গেছে। ২৬ অক্টোবর রাতে এ দুই প্রতিদ্বন্ধী চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবদুল লতিফের সমর্থক কাপ্তাই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান সদস্য ও প্রার্থী সজিবুর রহমান মারা যান। এ ঘটনায় করা মামলায় মহিউদ্দিন পাটোয়ারি বাদলকে অন্যতম আসামি দেওয়া হয়েছে।
রাইখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন-রুবেল মারমা (আওয়ামী লীগ), এনামুল হক (স্বতন্ত্র) ও মংথুই মারমা (স্বতন্ত্র) এবং ওয়াগ্গা উনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন- চিরঞ্জিত তঞ্চঙ্গ্যা (আওয়ামী লীগ) ও আফাই মারমা (স্বতন্ত্র)। এ উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৭ অক্টোবর দূর্বৃত্তদের গুলিতে চিৎমরম ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেথোয়াই মারমা নিহত হওয়ার ঘটনায় নির্বাচন ১১ নভেম্বর থেকে পিছিয়ে অনুষ্ঠিত হবে ২৮ নভেম্বর। আর মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়ায় চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন এ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
বরকল উপজেলায় ৪টি ইউনিয়নে যথা বরকল ইউনিয়ন, সুবলং ইউনিয়ন ও হরিণা ইউনিয়ন ও আইমাছড়া ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ১২জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর ৪টি ইউনিয়নে মোট ভোটার সংখ্যা ২৪ হাজার ৪শত ৭৮ জন, পুরুষ ১২ হাজার ৯শত ১৮, মহিলা ১১ হাজার ৫শত ৬১জন। আর ভোট কেন্দ্র ৩৬টি।
বরকলে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন-সুবলং ইউনিয়নে পবিত্র চাকমা (আওয়ামী লীগ), তরুণ জ্যোতি চাকমা (স্বতন্ত্র) ও আবুল কালাম আজাদ (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ), বরকল ইউনিয়নে প্রভাত কুমার চাকমা (আওয়ামী লীগ) ও নন্দ বিকাশ চাকমা (স্বতন্ত্র), আইমাছড়া ইউনিয়নে মো. নাসির উদ্দিন (আওয়ামী লীগ), সুবিমল চাকমা (স্বতন্ত্র) ও ইউসুফ আলী (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) এবং বড়হরিণা ইউনিয়নে নীলাময় চাকমা (জেএসএস সমর্থনপুষ্ট স্বতন্ত্র), বিনয় কৃঞ্চ (স্বতন্ত্র), ধনলাল চাকমা (স্বতন্ত্র) ও সঞ্জয় মনি চাকমা (স্বতন্ত্র)। এ উপজেলায় ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়ায় অপর ইউনিয়ন ভুষণছড়ায় এ পর্যায়ে নির্বাচন হচ্ছে না।
বিলাইছড়ি উপজেলায় বিলাইছড়ি সদর, কেংড়াছড়ি ও ফারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিন ইউনিয়নে মোট ১১ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ৩ জন, বাকীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী। এছাড়া সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে মোট-২৪ জন ও সাধারণ সদস্য (মেম্বার)পদে সর্বমোট ৭৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সদস্য পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন ২ জন।
৩ ইউনিয়নে সর্বমোট ভোটার সংখ্যা-১৯৩৩৭ জন। তার মধ্যে পুরুষ ১০১২৯ জন মহিলা ৯২০৮ জন। আর এর মধ্যে ১নং বিলাইছড়ি ইউনিয়নে ৬৩০১ জনের মধ্যে মহিলা ২৯৭৬ জন, পুরুষ ৩৩২৫ জন ভোটার। আর ২নং কেংড়াছড়ি ইউনিয়নে ৪৭৩৫ জন, তারমধ্যে পুরুষ ২৩৭৭ জন, মহিলা ২৩৫৮ জন ভোটার এবং ৩নং ফারুয়া ইউনিয়নে-৮৩০১ জন তার মধ্যে পুরুষ ভোটার ৪৪২৭ জন, ৩৮৭৪ মহিলা ভোটার। আর ২৭টি ভোট কেন্দ্রে কাল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিলাইছড়িতে ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীরা হলেন-বিলাইছড়ি সদর ইউনিয়নে ভদ্রসেন চাকমা (আওয়ামী লীগ), সুনীল কান্তি দেওয়ান (স্বতন্ত্র) ও মিঠুন তঞ্চঙ্গ্যা (স্বতন্ত্র), কেংরাছড়ি ইউনিয়নে রামা চরণ মারমা ওরফে রাসেল (আওয়ামী লীগ), অমরজিৎ চাকমা (স্বতন্ত্র), টিপু চাকমা (স্বতন্ত্র) ও সমতোষ চাকমা (স্বতন্ত্র) এবং ফারুয়া ইউনিয়নে বিদ্যালাল তঞ্চঙ্গ্যা (আওয়ামী লীগ), জীবন বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা (স্বতন্ত্র), নির্মল তঞ্চঙ্গ্যা (স্বতন্ত্র) ও চাইথোয়াই মারমা (স্বতন্ত্র)। এ উপজেলায় ৪টি ইউনিয়নের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়ায় বড়থলি ইউনিয়নে এ পর্যায়ে নির্বাচন হচ্ছে না।
এদিকে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার ২নং রাইখালী, ৪নং কাপ্তাই এবং ৫নং ওয়াগ্গা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই তিন ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ৭ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ২৩ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী প্রার্থী এবং ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় আছেন, তবে সাম্প্রতিক সময়ে চিৎমরম ইউনিয়ন এবং কাপ্তাই ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় ক্ষমতাসীন দলের ২জন নেতা নিহত হওয়ায় তাদের মনে কিছুটা ভয় এবং শঙ্কা কাজ করছে বলে জানান।
বুধবার (১০ নভেম্বর) সকাল হতে ৩টি ইউনিয়ন এর ২৭ জন প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে নির্বাচনী সরঞ্জাম বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার সবচেয়ে দূর্গম এলাকা হিসাবে খ্যাত ২নং রাইখালী ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতিক নিয়ে থোয়াই সা প্রু চৌধুরী (রুভেল), স্বতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতিক নিয়ে মংক্য মারমা এবং চশমা প্রতিক নিয়ে এনামুল হক প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। এই ইউনিয়নে সাধারণ সদস্য পদে ২৫ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই ইউনিয়নে মোট ভোটার ১৩ হাজার ১শত ৩ জন।
৪নং কাপ্তাই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতিক নিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুল লতিফ ভোটের লড়াইয়ে আছেন। এই ইউপিতে তাঁর একমাত্র প্রতিপক্ষ আনারস প্রতিক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন পাটোয়ারী বাদল ইউপি সদস্য সজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের আসামি হয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। এই ইউনিয়নে সাধারণ সদস্য পদে ২৩ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এই ইউনিয়নে মোট ভোটার ১১ হাজার ৬ শত ৪ জন। ৫নং ওয়াগ্গা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান চিরনজীত তঞ্চঙ্গ্যা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাঁর একমাত্র প্রতিপক্ষ আনারস প্রতিক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী স্বতন্ত্র প্রার্থী আপাই মারমা।
এই ইউনিয়নে সাধারণ সদস্য পদে ২০ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই ইউনিয়নে ভোট ভোটার ৭ হাজার ২ শত ৭৪ জন।
কাপ্তাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ নাসির উদ্দীন এবং চন্দ্রঘোনা থানার ওসি ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক মাঠে আছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। কেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন এবং বিজিবির টহল দল প্রতিটি কেন্দ্রের টহল দিবেন।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তানিয়া আক্তার জানান, কাপ্তাইয়ে অতীতেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে আশা করছি এই নির্বাচনও অবাধ সুষ্ঠু হবে। তিনি কোন কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ন নয় বলে জানান।
কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনতাসির জাহান জানান, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে গত ৯ নভেম্বর হতে কাপ্তাই উপজেলায় ৫ জন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এইছাড়া গত ৬ নভেম্বর হতে আচরণবিধির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) মোহাম্মদ মঈনুল হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব পালন করে আসছেন।