সংরক্ষিত বনের বিলুপ্ত প্রায় সাম্বার হরিণের মৃত্যুতে বন কর্মকর্তাদের শোক

14

॥ কাজী মোশাররফ হোসেন, কাপ্তাই ॥
একটি বন্য হরিণের মৃত্যুতে বন বিভাগের কর্মকর্তারা যে কতটুকু শোকাহত হতে পারেন, কতটা দুঃখ পেতে পারেন এবং কতটা মর্মাহত হতে পারেন তা আগে কখনো দেখিনি এবং শুনিওনি। এবারই প্রথম দেখলাম বনে বিচরণকারী হরিণের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বন বিভাগের সর্বস্তরের কর্মকর্তা এবং কর্মচারি কতটা শোক বিহবল হতে পারেন।
জানা গেছে, কয়েকদিন আগে বিকালে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হতে একটি সাম্বা হরিণ পানি খাবার জন্য কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত স্পীল সংলগ্ন নদীর কাছাকাছি আসে। এসময় স্থানীয় লোকজন হরিণটিকে দেখে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। হরিণটি বনে ফিরে যাবার সুযোগ না পেয়ে কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং এক পর্যায়ে নদীর পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। খবর পেয়ে লোকজন নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ওমর ফারুক স্বাধীন। তাঁরা অনেক চেষ্টায় হরিণটিকে পানি থেকে উদ্ধার। কিন্তু ততক্ষণে হরিণটি প্রায় খারাপ অবস্থা। হরিণটিকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে তুলতে বন বিভাগের লোকজন একটি মিনি ট্রাকে করে হরিণটিকে বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। এদিকে খবর দেওয়া হয় কাপ্তাই প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ এনামুল হক হাজারীকে। খবর পেয়ে প্রাণী সম্পদ কার্যালয় থেকে ২ জন পশু চিকিৎসক দ্রুত ছুটে আসেন। কিন্তু তাঁরা চিকিৎসা শুরুর পূর্বেই হরিণটি মারা যায়।
এই হরিণটি মারা যাবার পর থেকে বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারিরা সবাই অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়েন। হরিণটি পানি খাবার জন্য নদীর কাছাকাছি আসে। স্থানীয় লোকজন হরিণটিকে ধরার জন্য চারদিন থেকে ঘিরে ফেলে। এবং এক পর্যায়ে নদীতে পড়ে হরিণটি মারা যায়। একটি হৃষ্টপুষ্ট ও তরতাজা হরিণ এভাবে চোখের পলকে মরে গেল, অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে না পারার বেদনা থেকে বন কর্মকর্তারা শোকাহত হন।
কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ওমর ফারুক স্বাধীন বলেন, এটি ছিল একশ কেজি ওজনের সাম্বার পুরুষ হরিণ। তাকে উদ্ধার করার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের ডিএফও সাজ্জাদ হোসেন অনবরত হরিণটির খোঁজ নিচ্ছিলেন। যে কোন উপায়ে হরিণটিকে সুস্থ্য করে তোলার জন্য তিনি কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। কিন্তু হরিণটির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সব চেষ্টা বিফলে যায়।
কাপ্তাই উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ড. এনামুল হক হাজারী বলেন, সম্ভবত মানুষের তাড়া খেয়ে ভয়ে পানিতে পড়ে হরিণটি ষ্ট্রোক করে। তিনি বলেন আমরা চিকিৎসা শুরুর পূর্বেই হরিণটি মারা যায়। কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা ওমর ফারুক স্বাধীন বলেন, এটি ছিল একটি সাম্বার হরিণ। এর ওজন ছিল ১০০ কেজি। সম্পুর্ণ সুস্থ্য থাকা সত্বেও শুধু মাত্র মানুষের তাড়া খেয়ে হরিণটি মারা যায়। তবে হরিণটি মারা গেলেও আমরা তিন দিন এটিকে বিশেষ ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করি। উর্দ্ধতন বন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঢাকা থেকে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কাপ্তাই আসেন। ডুলাহাজরা থেকে আসেন ২ সদস্যের একটি টিম। তারা ময়না তদন্ত করার জন্য মৃত হরিণের অস্থি মজ্জা সংগ্রহ করেন এবং গতকাল সেগুলো ঢাকা নিয়ে যান। ময়না তদন্তের পর হরিণটির সারা শরীরে কেরোসিন মেখে তাকে কাপ্তাই রেঞ্জ সংলগ্ন এলাকায় মাটি চাপা দেওয়া হয়। মৃত হরিণের গায়ে কেরোসিন মাখানোর বিষয়ে ওমর ফারুক স্বাধীন কলেন, কিছু মানুষ আছে তারা মাটি চাপা থেকে হরিণটি তুলে ফেলতে পারে এবং খাবার জন্য এর মাংস সংগ্রহ করতে পারে। তা যেন করতে না পারে সে জন্য কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
বন কর্মকর্তা খন্দকার মাহমুদুল হক মুরাদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল থেকে সাম্বার হরিণ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোনভাবে হয়তো ২/১টা হরিণ লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে এখনো টিকে আছে। এই হরিণটি পানি খেতে এসে এভাবে জীবন দেবে তা আমরা মেনে নিতে পারছিনা।
যশোহরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেকের মতে বন্য পশু পাখি লোকালয়ে এসে মানুষের সম্পদ নষ্ট করছে। প্রকৃত অর্থে পশু পাখি লোকালয়ে আসছেনা বরং মানুষই বন জঙ্গল ধংস করে পশু পাখি ও জীবজন্তুর আবাস স্থল সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। বন্য প্রাণীকে উত্যক্ত করা বা তাদের আবাস স্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্থ না করার জন্য আইন রয়েছে। এই আইন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিরও বিধান রয়েছে। কিন্তু কখনো এই আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের ডিএফও মোঃ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মানুষের অমানবিক আচরণে বনে এখন বন্যপ্রাণী নাই বললেই চলে। তারপারও যা কিছু আছে সেগুলোকে রক্ষা করতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। বনের পশু পাখিকে উত্যক্ত না করার জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও মানুষ নানা উপায়ে বন্য প্রাণী শিকার করে বা ফাঁদ পেতে মেরে ফেলে। এই সাম্বার হরিণটি ছিল একেবারে তরতাজা। সাথে এর সঙ্গীও থাকতে পারে। মানুষ এমন একটি সুস্থ হরিণকে ধাওয়া দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে ফেলে মেরে অমানুষের পরিচয় দিয়েছে। এর নিন্দা জানানোর ভাষা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।