॥ মনসুর আহম্মেদ, রাঙ্গামাটি ॥
রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ে দেখা মিলল বিরল ও বিশ্ময়কর প্রজাতির গোলাপি রঙের নতুন হাতির শাবক বাচ্চার। দেশে প্রথম বারের মতোই রাঙ্গামাটির পাহাড়ে দেখতে পাওয়া বিরল এই গোলাপি হাতির বাচ্চাটির বয়স আনুমানিক ২ সপ্তাহের একটু বেশি হবে বলে নিশ্চিত করেছেন রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার সুভলংয়ের বরুণাছড়ি ইউনিয়নের ফরেষ্টের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের দায়িত্বে থাকা প্রধান সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম।
বাংলাদেশে এর আগে এমন রঙের হাতির দেখা পাওয়া যায়নি এবং এটাই প্রাণিজগতে বাংলাদেশে গোলাপি রঙের হাতির প্রথম বিশ্ময়কর ঘটনা হতে পারে। রাঙ্গামাটি শহর থেকে এক থেকে দেড় ঘন্টা স্পিডবোট করে ঘটনাস্থলে যাওয়া যায়। সাধারন বোটে হলে সময় আরো একটু বেশি লাগতে পারে।
রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার বরুনাছড়ি ইউনিয়নে দুর্গম পাহাড়ে হাতির অবস্থান থাকা ঘটনাস্থলে গিয়ে আলাপকালে ফরেষ্টের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ই আর টি) দায়িত্বে থাকা প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনিই প্রথম দেখতে পান একটি হাতির পাল গোলাপি রঙের নতুন হাতির শাবকসহ বরুনাছড়ি এলাকায় কাপ্তাই হ্রদ পার হতে। পরে জাহাঙ্গীর আলম সেই দৃশ্যটি সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও ধারন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিমকে পাঠান। তিনি সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীর আলম জানান, বর্তমানে বরুনাছড়িতে হাতির নতুন গোলাপি বাচ্চাসহ দুটি হাতির শাবক এবং আরো ৬টি হাতিসহ সর্বমোট ৮টি হাতির পাল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন গোলাপি বাচ্চাসহ ৫টি একটি গ্রুপে, ২টি হাতি একসাথে এবং আরো একটি বড় হাতি সেখানে অবস্থান করছে।
সদ্য জন্ম নেয়া হাতির ছোট শাবকটি গোলাপি রঙের। সাধারণত বাচ্চা হাতির সারা গায়ের লোম কালো হলেও নতুন বাচ্চার গায়ের রং অনেকটাই গোলাপি এবং কিছুটা ব্যতিক্রম এই গোলাপি শাবক। ঘটনাস্থলে গিয়ে গত মঙ্গলবারও সেসব হাতির অবস্থান আমরা দেখতে পাই।
এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সার্কেলের বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল সরকার বলেন, পাহাড়ে হাতি সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগ ছাড়াও আমাদের ফরেষ্ট বিভাগের দায়িত্বরত ব্যক্তির পাশাপাশি আরো একটি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ই আর টি) টিম রয়েছে। তারা সব সময় পাহাড়ে থাকা হাতির সমস্যাসহ নানা বিষয়গুলো তদারক করে থাকে। আমরা এই টিমের মাধ্যমেই গত ১৩ই জুন জানতে পারি বরকলের বরুনাছড়িতে গোলাপি রঙের হাতির নতুন বাচ্চা শাবকের কথা জানতে পারি। এটার খবর পেয়ে আমরা ইতিমধ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে আমিসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সেখানে গিয়ে নতুন গোলাপি রঙের হাতির শাবকের দেখা পাওয়া গেছে বলে জানিয়ে বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল সরকার জানান, নতুন এই বিশ্ময়কর গোলাপি রঙের হাতির দিকে বন বিভাগ নজর রাখছে।
তবে কি কারনে হাতির বাচ্চাটির রঙ গোলাপি এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল সরকার জানান, নিউটেশনজনিত কারনেও হাতির বাচ্চার রং এরকম পরিবর্তন হতে পারে, এটি একটি গবেষণার বিষয় এবং এটা নিশ্চিত করতে একটু সময়ও লাগবে।
রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার বরুনাছড়িতে ঘটনাস্থলে দেখা হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ^-বিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক এম মনিরুল এইচ খানের সাথে। তিনি হাতির বাচ্চা শাবকের গোলাপি রঙের বিষয়ে জানান, সাধারনত হাতির গায়ের রঙ কালছে ধরনের হয়ে থাকে। কোন কারনে যদি হাতির চামড়ায় যে রঞ্জক পদার্থ তৈরী হয় তা যদি কোন অস্বাভাবিকতার কারনে সেটি তৈরী না হয় তখন সেটি কিছুটা ফ্যাকাসে বা গোলাপি রঙ ধারন করে এবং এই নতুন হাতির শাবকটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এটি অত্যন্ত একটি বিরল ঘটনা এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এটি হয়না। তিনি জানান, এটি হাতির জিনগত কোন অস্বাভাবিকতার কারনে অনেক সময় হাতির গায়ের রঙের ভিন্নতা আসে এবং এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
তিনি আরো জানান, এই পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ডসহ পুরো এরিয়াতে এশিয় হাতির রঙ এরকম গোলাপি রঙের হয় এটি অত্যন্ত একটি বিরল ঘটনা। আগেকার দিনে যখন রাজ-রাজাদের সময়কাল ছিলো তখন এই ধরনের বিরল সাদাটে বা গোলাপি হাতিগুলো রাজাদের কাছে খুবই কদরের হাতি ছিলো এবং রাজারা তাদের হাতিশালায় এসব হাতি শখ করে রাখতেন এবং এসব হাতিগুলোকে তখনকার রাজারা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কাজে তারা ব্যবহার করতেন। এরকম একটি বিরল হাতির রাঙ্গামাটির পাহাড়ে দেখতে পাওয়া গেছে এটা অবশ্যই একটি বিরল ঘটনা এবং এটি সংরক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব বলে মনে করি।
তিনি বলেন, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব অঞ্চলে বন্য হাতি আছে সেসব অঞ্চলের প্রায় বনাঞ্চলই দখল হয়ে বসতি, বাজারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে, ক্রমেই ধংস হয়ে যাচ্ছে হাতির আবাসস্থলসহ পাহাড়ের বনাঞ্চল। যে কারনে এক সময় হাতির নিরাপদভাবে বসবাস করতে পারলেও এখন তা অনেকটাই আর পারছেনা। বর্তমানে পাহাড়ে হাতি আর মানুষ অনেকটা একসাথেই বসবাস করছে। যার কারনে হাতি আর মানুষের দ্ব›দ্ধ অনেকটাই বেড়ে চলেছে এবং যার অনেক আলামত আমরা চারপাশেই দেখতে পাচ্ছি। এজন্য বর্তমানে যেসব সরকারী বনভুমি রয়েছে সেগুলো সংরক্ষন করে সেখানে যাতে প্রাকৃকিভাবে স্থানীয় উদ্ভিদ বেড়ে উঠতে পারে এবং সেই সাথে প্রয়োজন হলে এনরিচমেন্ট প্ল্যান্টাটেশন বা স্থানীয় যেসব উদ্ভিদ প্রজাতি ও বৃক্ষ প্রজাতি আছে সেগুলো বন বিভাগের মাধ্যমে যদি রোপণ করাসহ স্থানীয় জনগনকে সচেতন করতে হবে।
পাহাড়ের প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকাতে গোলাপি হাতিটি দেখতে এখন প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে বিভিন্ন গবেষকসহ উৎসুক জনগন। হাতির বাচ্চাটি ছোট থাকায় মা হাতিসহ অন্য হাতিরা তাকে হাতির শুড়ের উপর করেও কাপ্তাই লেক পাড় হতে দেখেছে। বর্তমানে যে টিলাতে হাতিগুলোর অবস্থান রয়েছে সেখানে নতুন হাতির গোলাপি শাবক বাচ্চা বড় না হওয়া পর্যন্ত আরো কয়েক মাস এই বুনো হাতির দল সেখানে অবস্থান করতে পারে বলে বাসসকে জানিয়েছেন এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ই আর টি) সদস্যরা।
তবে পাহাড়ে বিরল প্রজাতির এই গোলাপি হাতির বাচ্চাসহ পুরো হাতির দলকে নিরাপদে রাখতে সেখানে মানুষের অবাধ বিচরণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তা নাহলে যে কোন সময় অনাকাঙ্খিত ঘটনাসহ হাতির আক্রমণের শিকার হতে পারে মানুষ। তাই পুরো এলাকাটি সরকারীভাবে সংরক্ষণ করাটা অনেক জরুরী।