প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেন একটি প্রাণও ক্ষতি না হয় সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে-মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ

15

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে গত বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে রাঙ্গামাটি, কাউখালী, কাপ্তাইসহ পুরো জেলায় শুরু হয়েছে মাঝারি ও ভারি বৃষ্টি। গত কয়েক দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টি স্থায়িত্ব হওয়ায় রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পাহাড় ধসের শঙ্কা। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য দুর্যোগ এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সতর্কতা জারি করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে প্রচার করা হচ্ছে সতর্কবার্তা। শুধু রাঙ্গামাটি জেলা সদর নয় কাউখালী, কাপ্তাই ও নানিয়ারচরসহ জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোতে যেখানে বিগত বছরগুলোতে পাহাড় ধসে প্রানহানির ঘটনা ঘটেছে সেসব উপজেলায়ও নেয়া হয়েছে সর্ব্বোচ্য সতর্কবস্থা।
জেলা প্রশাসন জানায়, বর্ষায় রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড় ধসসহ যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্ততি নিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় শহরসহ রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত লোকজনের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্কতা জারি করে সচেতনতামূলক সতর্কবার্তা প্রচার করছে জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেলে ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে তাৎক্ষণিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বলা হচ্ছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (২৯ মে) বিকেল ৩টায় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ রাঙ্গামাটি ভেদভেদী লোকনাথ মন্দির মাঠ প্রাঙ্গণে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকি বিষয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী লোকজন, বিভিন্ন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেন।
এসময় রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, রাঙ্গামাটির ভেদভেদি, লোকনাথ মন্দির ও বিএডিসি এলাকা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, পাহাড় ধসসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে তাতে যেন একটি প্রাণও ক্ষতি না হয় সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই রাঙ্গামাটিতে সম্ভাব্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাক-প্রস্ততির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি স্থানীয়দের সাথে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় করে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসার অনুরোধ করেন। এসময় জেলা প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে কাউখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী আতিকুর রহমান কাউখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিপূর্ন অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করার আহবান জানিয়েছেন। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষনা করে ইতিমধ্যে সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছে বলে জানিয়েছেন।
রাঙ্গামাটির স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও রাঙ্গামাটি পৌরসভার প্রশাসক মো. মোবারক হোসেন জানিয়েছেন জেলা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন। এরপর ২২ মে থেকে স্থানীয়দের সতর্ক করা হচ্ছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, বৃষ্টির পরিমাণ বাড়ায় রাঙ্গামাটিতে প্রাণহানি এবং জানমালের ক্ষতি এড়াতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরতদের মাঝে প্রশাসন আগাম সতর্কতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এ ধরনের সতর্কতামূলক কার্যক্রম চলবে। তবে বৃষ্টি আরো দীর্ঘ মেয়াদী স্থায়ী হলে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হবে।
এদিকে জেলা শহরে পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ৩১টি স্থানের মধ্যে ভেদভেদী, শিমুলতলী, রূপনগর, যুব উন্নয়ন এলাকা অন্যতম। তবে বিস্ময়কর হলো ওইসব এলাকায় জনবসতি বেড়েই চলেছে। অথচ ২০১৭ সালের পাহাড় ধসের ক্ষতচিহ্ন এখনো দৃশ্যমান রয়ে গেছে। এরপরও পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছে মানুষ। মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও বেড়েছে পাহাড়ের ঢালে বসবাস। গড়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় পাঁচ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। শুধু শহরে ৩১টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শহরের আনাচে-কানাচে এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বহু পরিবারের মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে বসবাস করছে পাহাড়ের ঢালে ও পাদদেশে। জেলায় পাহাড় ধসসহ সম্ভাব্য দুর্যোগের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে প্রস্ততিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া আছে। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা, জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের নিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের বলে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাতে টানা তিনদিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে রাঙ্গামাটিতে ঘটে যায় স্মরণকালের পাহাড় ধসের ঘটনা। ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় পাঁচজন সেনাসদস্য, নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনা ক্যাম্পের নিচে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের উপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে পুনরায় পাহাড় ধসের মাটি চাপা পড়ে নিহত হন ওই ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ পাঁচ সেনাসদস্য। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মানিকছড়ি শালবাগান অংশে ১০০ মিটার রাস্তা সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে দীর্ঘ ৯ দিন সারাদেশের সঙ্গে রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। পরবর্তী ২০১৮ সালের জুনে জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় ফের পাহাড়ধসে ২ শিশুসহ ১১ জন এবং ২০১৯ সালের জুনে জেলার কাপ্তাইয়ে তিনজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।