ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সামাজিক উৎসব বৈসুক ও আনুষ্ঠানিকতা

98

॥ লিটন শীল ॥
বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু, সাংক্রান একটি সার্বজনীন ও সামাজিক উৎসব। এ সামাজিক উৎসবকে প্রতি বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা অতি আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে পালন করে থাকে। বিশেষ করে এ সামাজিক উৎসবটি পালন করে থাকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা’সহ পার্বত্যঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন নৃ-গোষ্টীরা। তবে এটি সার্বজনীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব হওয়ায় সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ের পাড়ায়-মহল্লায় এখন উৎসবের আমেজ বইছে।
অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীদের ন্যয় ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসব সাধারণতঃ তিনদিন পালন করা হয়। বাংলা বছরের শেষ দিনের পূর্ব দিনকে হারি বৈসুক, শেষ দিনকে বৈসুকমা আর বাংলা নতুন বছরকে বলে আতাদাক বা বিসি কাতাল।
ত্রিপুরাদের তিনদিনের এ সামাজিক উৎসব “হারি বৈসুক” সম্পর্কে ত্রিপুরা কল্যান ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিদ্যুৎ শংকর ত্রিপুরা বলেন, এ দিনে এলাকার ছেলে-মেয়েরা ভোরে উঠে প্রথমে বিভিন্ন রকমের ফুল ও নিম গাছের ছোট ছোট পাতাযুক্ত ডাল সংগ্রহ করবে। সে ফুল ও নিমের ডাল দিয়ে ঘর ও মন্দির সাজাবে। তারপর শরীরে কুচাই তুই (পবিত্র পানি) ছিটিয়ে পবিত্র হয়ে নদীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দ্যেশে কলা পাতায় ফুল ভাসিয়ে গঙ্গাদেবীকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রার্থনা করে যেন, পুরাতন বছরের সব গ্লানি, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে দূর হয়ে যায় এবং নতুন বছরের প্রতিটি দিনগুলো যেন সকলের মাঝে সুখ শান্তি মঙ্গল বিরাজ করে ও দুঃখ যন্ত্রনা হতে সকল ধর্মের মানুষ যেন পরিত্রাণ পায়। এরপর নদী থেকে কলসীভরে পানি এনে বয়োঃজ্যোষ্ঠদের স্নান করিয়ে প্রনাম কওে আর্শিরবাদ গ্রহণ শেষে নতুন কাপড় চোপড় উপহার দেওয়া’সহ অন্যান্য ধর্মীয় কাজগুলো সেরে নেবে। তিনি বলেন, বৈসুক উৎসবের এক সপ্তাহ পূর্ব হতে পাড়ার যুবক-যুবতীরা পাড়া প্রধান ও মুরুব্বিদের অনুমতি নিয়ে একজন ওঝার নের্তৃত্বে দল বেঁধে গড়াইয়া নৃত্যও মহড়া দেওয়া হয় এবং হারি বৈসুক দিনে গড়াইয়া দেবতার পুজা দিয়ে পুজার আর্শিরবাদ কাপড় বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে গড়াইয়া নৃত্যর পরিবেশন করা হয়। তাদের বিশ^াস কারায়া ও গরয়া হচ্ছে বনের হিংস্র পশুদের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা। দেবতা তাদের পুজার আর্শিরবাদ গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে জুমচাষ ভালো হবে ও বিভিন্ন কাজে বনে গেলে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।
তিনি জানান, প্রতি বছরের ন্যয় এ বছরও ত্রিপুরা কল্যান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বৈসুক সংত্রান্তি নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এরমধ্যে সকল জাতির মঙ্গল কামনায় আগামী ১২ এপ্রিল শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা তাদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নদীতে গঙ্গাদেবীর উদ্দ্যেশে ফুল ভাসাবে, বয়োঃজ্যোষ্ঠদের স্নান শেষে নতুন কাপড় চোপড় উপহার দেওয়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে ত্রিপুরা কল্যান ফাউন্ডেশন।
”বৈসুকমা” দিন সম্পর্কে ত্রিপুরা কল্যান ফাউন্ডেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঝিনুক ত্রিপুরা বলেন, বৈসুকমা দিনটি হচ্ছে পুরাতন বছরের সর্বশেষ দিন। পুরাতন বছর হতে নতুন বছরে পদার্পণ করার অতি শুভক্ষণ এটি। এই দিনটি ত্রিপুরা জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে ত্রিপুরা জাতির লোকজন কিছু নির্দিষ্ট আচার অনুষ্ঠান বা নিয়ম নীতি পালন করে থাকে। জীব হত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধও নিরামিষ জাতীয় খাবার আহার করার বিধান রয়েছে এই দিনে।এ দিনে প্রধান আপ্যায়নের বস্ত হচ্ছে পাঁচন তরকারী। এটি বিভিন্ন শাক-সবজি মিশ্রণ করে রান্না করা হয়। এর কারণ হচ্ছে বছরের শেষে ঋতু পরিবর্তনের সময় বিভিন্ন শাক-সবজি মিশ্রন করে রান্না করে খেতে পারলে পরবর্তী বছরে রোগ হওয়ার কোন সম্ভবনা থাকেনা। পাঁচনেরপাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পিঠা, পায়েস’সহ অনেক রকম খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয়।
“আতাদাক বা বিসি কাতাল” অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিন সম্পর্কে জুরাছড়ি ভুবনজয় সরকারী উ”চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজীব ত্রিপুরা বলেন, আতাদাক হলো ত্রিপুরাব্দের প্রথম দিন। বছরের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা আতাদাক বা বিসি কাতাল বলে থাকেন। এই দিনে সকল প্রকার আমিষ জাতীয় খাদ্যের ব্যবস্থ করা হয়। যাতে করে পরিবার পরিজন ও আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে সারাবছর এভাবে খেতে ও আপ্যায়ন করতে পারে। তিনি বলেন, এটি সার্বজনীন ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসব। এতে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাও অংশগ্রহণ করতে পারে। এ উৎসবের আপ্যায়ন পর্বে কাকেও বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয় না। জাতি ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সকলেই এ উৎসবে সমানভাবে অংশগ্রহন করে থাকে।