লোকসান কাটিয়ে কেপিএম ঘুঁরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা: নতুন মিল স্থাপনের উদ্যোগ

105

॥ ঝুলন দত্ত, কাপ্তাই ॥
১৯৫৩ সালে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ১ নং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন এর কর্ণফুলি নদীর তীরে মোট ৫০১ একর জমির উপর তৎকালীন পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ (পিআইডিসি) ৬৮ একর কারখানা এবং ৪৩৩ একর আবাসিক এলাকা নিয়ে কর্ণফুলি পেপার মিলস (কেপিএম) গড়ে তোলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয়।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বার্ষিক ৩০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। সে সময় দেশের সরকারি চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ কাগজ সরবরাহ করতো কেপিএম। কালক্রমে বয়সের ভারে ধীরে ধীরে ৭২ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠানটি জরাজীর্ণ ও রুগ্ন শিল্পে পরিনত হয়ে পড়ে। নানা সমস্যায় জর্জরিত কারখানাটি দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এক সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারনায় মুখরিত থাকা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। নানা প্রতিকুলতা মাঝে মিলটির উৎপাদন আজও চালু রাখা হয়েছে। তবে স্থানীয় বাজারে কাঁচামাল আহরণে বেসরকারি মিলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতাই টিকতে না পারে, কাঁচামালের দাম উদ্ধর্গতি হওয়ায়, পুরাণো যন্ত্র দিয়ে উৎপাদন করা এবং দক্ষ লোকবলের অভাবে প্রতি টন কাগজ উৎপাদনে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লস হচ্ছে বলে জানান কেপিএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো: শহীদ উল্লাহ।
এমডি আরোও বলেন, এক সময়ের দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত কাগজ কল কেপিএম ইতিমধ্যে ৭২ বছর পেরিয়ে গেছে। বয়সের ভারে জরাজীর্ণ কারখানায় নানাবিধ সমস্যা বিরাজ করছে। কাঁচামাল এবং লোকবল সংকটে মাসের অধিকাংশ সময় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ২৩ শত ৮৬ শ্রমিক কর্মচারির সেটআপ থাকলেও বর্তমানে ১৮৮ জন স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারি, কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশের মধ্যে উন্নত মানের কাগজ উৎপাদন করছে কেপিএম। রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে কেপিএম এর কাগজ এর প্রচুর চাহিদা থাকা স্বত্তেও আমরা কাগজ দিতে পারছি না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন এবং প্রতি বছর কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে সরকার যে পাঠ্য বই সরবরাহ করে তার বেশী ভাগ যোগান দিতো কেপিএম। নানাবিধ সমস্যা থাকার পরও স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক, কর্মচারি, কর্মকর্তা এবং দৈনিক ভিত্তিক কিছু অস্থায়ী শ্রমিক কাজে লাগিয়ে আমরা মাঝে মাঝে উৎপাদনে যাই। কারখানার ২টি পেপার মেশিন উৎপাদনের প্রস্তুত থাকলেও প্রয়োজনীয় লোকবল সংকট এবং কাঁচামাল সংকটে আমরা মাত্র ১টি মেশিন চালু রেখে উৎপাদন করে যাচ্ছি। দেশের সার কারখানা গুলোতে সরকার ভর্তুকি দেওয়ায় প্রতি ঘনফুট গ্যাস তারা ১৬ টাকায় পাচ্ছে, কিন্তু কর্ণফুলী পেপার মিলে প্রতি ঘনফুট গ্যাস ৩০ থেকে সাড়ে ৩১ টাকা হারে কিনতে হচ্ছে। সার কারখানার মতো কেপিএমে গ্যাস ক্রয়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে অর্ধেক দামে ক্রয় করার সুযোগ করে দিলে কেপিএমের কাগজ উৎপাদন ব্যয় বহুলাংশে কমতো। বর্তমানে মিল চালু অবস্থায় প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ মে. টন উৎপাদন হলে প্রায় ১৩ লক্ষ টাকার গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে। ফলে উৎপাদন করার পরেও মিলকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
কেপিএম এর এমডি মো শহীদ উল্লাহ আরোও বলেন, কেপিএম এলাকায় একটি ইন্টিগ্রেটেড পাল্প এন্ড পেপার মিলসহ আরো ৬টি কেমিক্যাল প্ল্যান্ট স্থাপনের সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। নতুন কারখানা বসানোর জন্য ২৮ হাজার টাকার একটি প্রকল্প বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শিল্প মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী বছর এডিপিতে উক্ত প্রস্তাব উত্থাপন হতে পারে। নতুন ভাবে মিল নির্মিত হলে কাগজ শিল্পে কেপিএমের হারানো গৌরব ফিরে আসবে।
এছাড়া বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকা মিলের কাগজ রূপান্তর প্লান্টটি পুনরায় চালু করার পাশাপাশি বিদেশী পাল্প স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি আমদানী করা গেলে উৎপাদন ব্যয় অনেকাংশে কমে যেত। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে মিলটি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কেপিএম ঘুরে দাঁড়ালে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধি হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
কেপিএম এর জি এম (উৎপাদন) মো: মইদুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকেই কেপিএমে বাঁশ-পাল্পউডের (নরম কাঠ) মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মন্ড তৈরি করে কাগজ উৎপাদন করা হতো। কিন্তু বিগত ৮ বছর ধরে জরাজীর্ণ হওয়ায় এবং মেশিন ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় মন্ড তৈরির পাল্প মিলটি বন্ধ রয়েছে। এরপর থেকে বিদেশ থেকে আমদানী করা পাল্প ও দেশীয় অকেজো কাগজ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন চালু রাখা হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় মিলটি চালু থাকার পরও নিয়মিত লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে কেপিএম কর্তৃপক্ষ প্রতি টন উৎপাদিত কাগজ বিক্রি করছে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকায়। অথচ দেশী কাঁচামাল সংগ্রহ করে প্রতি টন কাগজ উৎপাদন করতে কেপিএম এর খরচ হচ্ছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। এতে প্রতিটনে কেপিএম লস দিচ্ছে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকার মতো। যদি বিদেশ হতে পাল্প এনে উৎপাদন করা যেতো তাহলে লস কিছুটা কমানো সম্ভব হতো।
কেপিএম সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উৎপাদন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানটিকে বছরে প্রায় ২৮-৩০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই কেপিএমকে বাঁচাতে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে ইন্টিগ্রেডেট পেপার মিলসহ বনায়ন, পেপার ভিত্তিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট, সোডা অ্যাশ, সোডিয়াম সালফেট ও বেসিক কেমিক্যাল প্ল্যান্ট (কাস্টিক সোডা, ক্লোরিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, ব্লিচিং আর্থ, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, সালফিউরিক এসিড, ফসফরিক এসিড ইত্যাদি) এবং সিনথেটিক পলিস্টার ফাইবার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। এতে এই কারখানাতে বছরে এক লক্ষ মেট্রিক টন কাগজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান বার্ষিক কাগজ উৎপাদন করছে ৩ থেকে ৪ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে, বর্তমানে মিলের ২৩৭৬ জন স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার সেটআপের বিপরীতে মাত্র ১৮৮ জন স্থায়ী শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ২৫০ জন অস্থায়ী ঠিকাদার শ্রমিক দ্বারা মিলের কার্যক্রম চলছে।
তবে কেপিএম নানা কারণে আগের মতো উৎপাদনে যেতে পারছেনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিলে দক্ষ কর্মকর্তা, শ্রমিক- কর্মচারীর অভাব, উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত গ্যাসের শতভাগ দাম বৃদ্ধি, চড়া মূল্যে বিদেশী পাল্প আমদানী করা, অর্থ সংকট, কাগজের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারা অন্যতম।
এলাকার শ্রমিক কর্মচারিরা বলেন, মিলটি পুরোদমে চালু করতে পারলে এই এলাকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন আসবে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি কাগজের বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে কেপিএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। কাগজের কাঁচামাল হিসেবে স্থানীয় বাঁশ, পাল্পউডের ব্যবহার বাড়বে এবং এরফলে এই এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে।