॥ আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
চার বছর আগের এক পরাজয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন খাদের কিনারে; সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, আততায়ীর বুলেট এড়িয়ে, অধিকাংশ মার্কিন ভোটারের সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্পের জন্য এ এক অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্প। এ দফায় তিনি ৪ বছরের জন্য হোয়াইট হাউজ নিশ্চিত করেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী, বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই চলে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলে ট্রাম্প জিতে নিয়েছেন ২৭৯টি ইলেকটোরাল ভোট। আর হ্যারিস পেয়েছেন ২২৩ ভোট।
লালে লাল রিপাবলিকান শিবির অবশ্য উৎসবে মেতে উঠেছিল আগেই। ২৬৬ ভোট নিশ্চিত হওয়ার পরপরই মঙ্গলবার রাতে ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ওয়াচ পার্টির মঞ্চে হাজির হন ট্রাম্প। সমর্থকদের হর্ষধ্বনির মধ্যে ‘নজিরবিহীন ম্যান্ডেট’ দেওয়ায় আমেরিকার জনগণকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
ট্রাম্পের এই জয়ের মধ্য দিয়ে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল যুক্তরাষ্ট্রে। তার আগে এই রেকর্ড ছিল কেবল গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১৮৯২ সালে।
৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প নানা নিরিখেই দেশটিতে ইতিহাস গড়লেন। তবে নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবেরকে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়ে বিশ্বকে আরো একবার হতবাক করল আমেরিকা।
ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে আসা ট্রাম্পের কেলেঙ্কারির শেষ নেই। দুনিয়াজুড়ে তাকে নিয়ে সমালোচনা আর শঙ্কারও কমতি নেই। তিনিই হতে যাচ্ছেন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট।
‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর দুইবার অভিশংসিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। তার পরও কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে তাকেই ফিরিয়ে আনল আমেরিকরা।
বিশৃঙ্খলা আর ঘরে-বাইরে সমালোচনার মধ্যে চারটি বছর হোয়াইট হাউজে কাটিয়ে ২০২০ সালের নির্বাচনে চরম নাটকীয়তার মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প, যদিও সেই পরাজয় তিনি কখনো মেনে নেননি।
ওই নির্বাচনের পর ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা চিহ্নিত হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কুখ্যাত এক অধ্যায় হিসেবে। মনে হচ্ছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়ত সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
কিন্তু ৪ বছর পর ভোটের মাঠে বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন যে শেষ পর্যন্ত তাকে ওভাল অফিসে নিয়ে যাবে তা অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল।
অবশ্য ভোটের আগেই ট্রাম্প সম্পর্কে তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ব্রায়ান লাঞ্জার বলেছিলেন, একবার পরাভূত হওয়ার পর দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন।
ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল- তাতে ধরে নেওয়া হয়েছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে। তার অনেক দাতা ও সমর্থক আর কখনও ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও অনুসারীদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সমর্থকরা তার লড়াকু মনোভাব ও মনে যা আসে তা স্পষ্ট করে বলাকে তার সততা ও সাহসের নজির বলে মনে করেন। প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকানরা যাই বলুক দলের কর্মীদের মধ্যে তার প্রভাব ব্যাপকভাবেই বজায় থাকে।
মামলা নিয়ে আদালতে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনি জনসভায় হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যান ট্রাম্প। আততায়ীর গুলি তার ডান কান চিরে বেড়িয়ে যায়।
তার সেই বেঁচে যাওয়ার পেছনে ঐশী উদ্দেশ্য ছিল, আর সেটা হল আবারও তাকে আমেরিকার নেতৃত্বে আনা– এমন ইংগিত ট্রাম্প মঙ্গলবার রাতের বিজয়োৎসবেও বলেছেন।
তিনি বলেছেন, “অনেক মানুষই আমাকে বলেছেন যে- ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়েছেন, সেটি কোনো একটি কারণের জন্যই।”
বক্তব্যের এক পর্যায়ের ট্রাম্প ভোটারদের পাশাপাশি স্ত্রী মেলানিয়াকেও ধন্যবাদ দেন। ট্রাম্প বলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়া ‘বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ। তার সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্রত নিয়ে কাজ করবে।
এবারের নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প মূল্যস্ফীতি, কর, গর্ভপাত, অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের সমর্থন কুড়িয়েছেন।
ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সবকিছু মানুষের ক্রয় সামর্থ্যের মধ্যে আনার। অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠালে আবাসনের ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন তিনি। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপেরও আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
ট্রাম্পও বিপুল পরিমাণ করছাড় দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। তবে সেটি তার ২০১৭ সালের কর কমানোর নীতিরই আরেক রূপ, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনীদের জন্যই সহায়ক ছিল।
নর্থ ক্যারোলাইনার সমাবেশে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, মেক্সিকো যদি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অভিবাসী অনুপ্রবেশ বন্ধের ব্যবস্থা না করে, তাহলে সব ধরনের মেক্সিকান পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন তিনি। তার এই ঘোষণা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অভিবাসীদের পাশাপাশি অন্য অনেক দেশের মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে আলোচনার একটি বড় বিষয় ছিল গর্ভপাতের অধিকার। হ্যারিস সারাদেশের নারীদের জন্য প্রজনন অধিকার সুরক্ষা আইনের পক্ষে তিনি কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছিলেন, নারীদের যাতে গর্ভপাতের কথা ভাবতে না হয়- সেটি তিনি নিশ্চিত করবেন।
সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের সময়ে নিয়োগ দেওয়া তিন বিচারকের হাতেই যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল হয়েছিল। সে কারণে গর্ভপাত ইস্যুতে নারীদের মন জয় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্রাম্পকে। তবে সেটা তার ফের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি।
এবারের নির্বাচনি প্রচারের সময় বিভিন্ন জনমত জরিপে আমেরিকানদের প্রায় অর্ধেকই বলেছিলেন, ৪ বছর আগের তুলনায় এখন তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। আর মঙ্গলবার ভোটের পর এডিসন রিসার্চের বুথফেরত জরিপে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে যাদের উদ্বেগ বেশি ছিল, তারাই ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন।