খাগড়াছড়িতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় ৭ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি

59

॥ খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি ॥
খাগড়াছড়িতে সহিংস ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনের কাজ করা হয়েছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের এ ঘটনায় সাত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন তথ্য জানানো হয়। অশান্ত পাহাড়ে ফিরতে শুরু করেছে শান্তি। তবে এখনো অদৃশ্য অজানা আতঙ্ক কাটেনি পাহাড়ি-বাঙালীদের মধ্যে। খাগড়াছড়িতে শান্তি ফেরাতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে নিরন্তন। সহবস্থান বজায় রাখতে স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করছে স্থানীয় প্রশাসন।
এদিকে স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালায় সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩ জন নিহত ২০ আহতসহ ৮৭টি স্থায়ী ও সড়কের পাশে ভ্রাম্যমান ৯৪ ব্যবসায়ীদের দোকান পুড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। লুট-পাট করে নিয়ে যাওয়া হয় ২৬টি দোকানের মালামাল। অগ্নিসংযোগ করা হয় পরিবহনেও ব্যাটারিচালিতি ইজিবাইক, সিএনজি, মোটরসাইকেলসহ ২০ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়। ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে ২৬টি দোকানে। এর মধ্যে স্থায়ী দোকানের মধ্যে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের ৩০টি ও পাহাড়ীদের ৫৭ টি দোকান রয়েছে।
লুট-পাট হওয়া মোবাইলের দোকান তারেং এর স্বত্তাধিকারী কুসুম চাকমা বলেন, আমার দোকানে ভাংচুর করে মোবাইলসহ ইলেকট্রনিক্সের সব মালামাল ছিলো নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার লারমা স্কয়ার এবং বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, সেদিনের বীভৎস সহিংসতার চিত্র। দোকানপাটের মালামাল পুড়ে কয়লা হয়ে পড়ে রয়েছে। দোকানের পুড়ে যাওয়া খুঁটির সারি দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে গত কয়েকদিন আগেও সাজানো গোছানো দোকান ছিল। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে জমজমাট ছিল। এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি দোকানের মালিক নতুন করে অবকাঠামো তৈরি করতে কাজ করছেন। অনেকেই জানিয়েছেন হতাশার কথা। ধারদেনা করে ঘুরে দাঁড়াবেন তারও উপায় নেই। অনেকে আবার আগের ঋণ কি করে পরিশোধ করবেন তা নিয়েও চিন্তিত। লারমা স্কয়ার এবং বাস টার্মিনালে পাহাড়ি-বাঙালি সব সম্প্রদায় ব্যবসা করতো। বোয়ালখালী বাস টার্মিনালের পাহাড়িকা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক দিপন চাকমা বলেন, উপার্জিত সব অর্থ ব্যয় করে গত কিছুদিন হলো নতুন করে দোকান তৈরি করেছেন। দোকানে মালামাল ভরপুর ছিল। দোকানটি ছিল তার একমাত্র আয়ের উৎস। সহিংসতায় তার দোকান পুড়ে অন্তত ৪০/৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সহায় সম্বল হারিয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। এখন তিনি কি করবেন, কিভাবে পরিবারের ভরণপোষণ চালাবেন, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
হোটেলের মালিক কণিকা চাকমা বলেন, সামনে হোটেল আর পেছনে ছিল তাদের থাকার ঘর। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে তাদের সবকিছুই পুড়ে গেছে। সহায়সম্বল হারিয়ে এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দিদারুল আলম বলেন, এখানে দীর্ঘ বছর ধরে পাহাড়ি-বাঙালি ভাই ভাই হিসেবে সম্প্রীতির বন্ধনে মিলেমিশে ব্যবসা বাণিজ্য করে আসছি। কেন এমনভাবে আগুন দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হলো? যে ক্ষতি হয়ে গেল তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে। তার হার্ডওয়ারসহ ভ্যারাইটিজ মালামালের দোকান ছিল। আগুনে ১৭/১৮ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে লারমা স্কয়ারে দুইটি বসতবাড়ি রয়েছে। সোলাইন রাখাইন ও এডিশন চাকমার। বসতবাড়ির সামনে নাপ্পির দোকান চালাতেন সোলাইন রাখাইন। তিনি বলেন, আগুনে পুড়ে ঘরবাড়ি, দোকানের মালামাল মিলে বিশ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।এছাড়া, আগুনে পুড়ে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে পুষ্প বিতান ও সাজঘর, আম্বিয়া ট্রেডার্স, কুসুম কুকারিজ, বিসমিল্লাহ বীজ ভান্ডার, ত্রিরত্ন মাইক সার্ভিস এবং প্রিয়দর্শী ট্রেডার্সের।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে মামুন হত্যার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দীঘিনালা কলেজের কয়েকজন বাঙালি শিক্ষার্থী মিছিল বের করে।এ মিছিল থেকেই এ সহিংসতার সৃষ্টি ।
প্রত্যক্ষদর্শী বিসমিল্লাহ বীজ ভান্ডারের মালিক আকতার হোসেন বলেন, দীঘিনালা থানা বাজার থেকে একটি মিছিল লারমা স্কয়ার, বোয়ালখালী গরুর বাজার হয়ে পুনরায় লারমা স্কয়ার হয়ে দীঘিনালা থানা বাজারের পথে যাওয়ার চেষ্টা করে। লারমা স্কয়ার পৌঁছালে হঠাৎ হট্টগোল শুরু হয়। সাথে শুরু হয় ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি। গুলতির সাহায্যে ছোঁড়া কিছু মার্বেল এসে পড়তে দেখা যায়। পাহাড়ি-বাঙালি দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধাঘণ্টার মতো চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। হঠাৎ করে বাজারের কয়েকটি স্থানে দোকানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ইটপাটকেল ছুঁড়াছুঁড়ির এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারের বটতলী সামনে থেকে কয়েক রাউন্ড রাইফেলের গুলি ছোঁড়ে। এতেই ঘটনার মোড় পাল্টে যায়। উত্তেজিত হয়ে যায় বাঙালিরা। কল্পরঞ্জন মাঠ এবং বোয়ালখালী বাজারে অবস্থান করে বাঙালিরা। হঠাৎ করেই লারমা স্কয়ারের দুই পাশে দুইটি দোকানে আগুনের ধোঁয়া উঠতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটার্মিনাল এবং লারমা স্কয়ার বোয়ালখালী সড়কে দুই দোকানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। গুজবের ফেসবুকে একটি ভিডিওতে গুলি করার একটি দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি একে অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। আগুনে লারমা স্কয়ার এবং বাস টার্মিনালের ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে।এর পরই পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের মাঝে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি শান্তি কমিটি করা হয়েছে। দীঘিনালার লারমা স্কয়ারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছেন তিনি।
সহিংসতার ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে পুলিশ বাদি হয়ে দীঘিনালা থানায় একটি মামলা হয়েছে। দীঘিনালা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, প্রায় সাত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সহিংসতার ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা ú্রস্তুত করা হয়েছে। তিনি জানান ইতিমধ্যে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে জেলা প্রশাসন থেকে ৭ লক্ষ টাকার চেক বিতরণ করা হয়েছে। পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে ২০ টন চাল এবং দুই লাখ বিশ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা দ্রুত বিতরণ করা হবে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, অপরাধীদের কোনো ক্ষমা নেই।সহিংসতার ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের আটক করে আইনের আওতায় নিতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরের নোয়াপাড়া এলাকায় একটি মোটর সাইকেল চুরির ঘটনার রেশ ধরে খাগড়াছড়ি ও দীঘনালায় সাম্প্রদায়িক হামলা,ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনার রেশ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। রুপ নেয় সাম্প্রদায়িকতায়। ঘটনায় ৪ জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়।