॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
মাটি আর আবহাওয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে তিন পার্বত্য জেলাকে বলা যায় ফলের স্বর্গরাজ্য। সারাবছরই পাহাড়ের বাজারগুলো সুরভিত থাকে কোনো না কোনো ফলের ঘ্রাণে। মৌসুমভেদে সারাবছরই নানা জাতের ফলে ভরপুর থাকে রাঙ্গামাটির স্থানীয় হাটবাজারগুলো। রঙ, ঘ্রাণ আর সুস্বাদু এবং ফরমালিন মুক্ত হওয়ায় এসব ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে।
প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কৃষকেরা অতিকষ্টে বিভিন্ন তরিতরকারি ও ফলমূল উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু প্রতিবছর কয়েক হাজার টন ফল উৎপাদিত হলেও দুঃখজনক হলো-উৎপাদিত এই ফলের পাঁচ ভাগের এক ভাগই নষ্ট হচ্ছে সংরক্ষণের অভাবে। আর মজুত করে রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে কম মূল্যে এসব কৃষি পণ্য বিক্রি করতে হয়। এতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যার মূল কারণ কৃষি ভিত্তিক শিল্পকারখানা ও হিমাগার না থাকা এবং বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠা।
বছর জুড়ে কলা, কাঁঠাল, আম, পেঁপে, আনারস, লিচু, জাম্মুরা, পেয়ারা, কমলা, তরমুজ ও জাম হাজার হাজার কোটি টাকার ফল উৎপাদন হলেও প্রক্রিয়াজাত ব্যবস্থা না থাকা পুরো এলাকার জন্যই যেমন ক্ষতি তেমনী উৎপাদনের বিশাল টাকার অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চাষিরা। অথচ এসব ফল প্রক্রিয়াজাত করা গেলে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের মতোই প্যাকেটজাত বা বোতলজাত করে সারাবিশ্বে রপ্তানি করা সম্ভব হতো বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বনরূপার সমতাঘাট ভাসমান ফলের বাজারে আসা ফল চাষিদের হতাশার গল্পের কথা জানিয়ে রূপন চাকমা বলেন, ভোরের আলো ফুটতেই ইঞ্জিন চালিত নৌকা বোঝাই করে কাঁঠাল নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা, বিক্রির নাম নেই। হতাশা নিয়ে বললেন, ফলের দাম নাই। তাই ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। পঞ্চাশোর্ধ কালাইয়ে চাকমা বলেন, এখনতো বাংলাদেশে সব পণ্যের দাম বেশি। কিন্তু আমাদের নিজের হাতে লাগানো ভালো জাতের ফলের দাম তো কম। এভাবে ফল বিক্রি করলে আমি কীভাবে চলব। এখানে যদি কোনো একটা ফলের ফ্যাক্টরি থাকত তা হলে ফলমূলগুলো আমাদের বেচতে সুবিধা হতো। এখনে তো আমাদের কিছু করার নাই। একদিন থাকলেই কাঁঠাল পেকে যায়। নষ্ট হয়ে যাবে। এতে করে কাপ্তাই হ্রদে ফেলে দেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
রাঙ্গামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, পাহাড়ে মৌসুমি ফল চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদন হয়। এর প্রায় ২০ শতাংশই পচে নষ্ট হয়ে যায়। এখানে কোনো কোল্ড স্টোরেজ নেই। তাই ভরা মৌসুমে চাষিরা অনেক কমদামে ফল বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে তারা নায্যমূল্যে থেকে বঞ্চিত হন।
রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, পাহাড়ের উৎপাদিত ফলের পঁচিশ ভাগই পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে বিরাট অংকের টাকা থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা বঞ্চিত হন। এখানকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ২ কোটি টাকার বেশি ঋণ-সুবিধা না দেওয়ায় হিমাগার স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। ফুড প্রসেসিং এবং সুষ্ঠু সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া গেলে এখানকার প্রান্তিক চাষিরা লাভবান হবেন। অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হবে পাহাড়। রাজস্ব আয় বাড়বে সরকারের।
তবে পাহাড়ে বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপনে সরকারের উদ্যোগ আছে বলে জানিয়েছেন, রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি। তিনি বলেন, রাঙ্গামাটিতে হিমাগার না থাকায় পাহাড়ে যে সব ফলমূল উৎপাদিত হয় তার বেশীর ভাগ নষ্ট হয়ে যায়। এতে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। তাই এখানে একটি হিমাগার তৈরীর পরিকল্পনা রয়েছে। হিমাগার যদি স্থাপন করা যায় তা হলে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলের প্যাকেটজাত বা বোতলজাত করে সারাবিশ্বে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর ফলের উৎপাদন বেশী হলেও কোন হিমাগার না থাকায় প্রতিবছর প্রচুর ফল মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতি থেকে রেহায় পেতে সরকারের কাছে হিমাগার স্থাপনের দাবী জানিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা।