বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি : যা জানা গেল

10

॥ রুমা প্রতিনিধি ॥
ঈদের আগে ডাকাতি হল সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখায়। সশস্ত্র ডাকাত দল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর হানা দেয় ব্যাংকটিতে।
ডাকাতরা ব্যাংক নিরাপত্তা রক্ষীদের আগ্নেয়াস্ত্রসহ অর্থ লুট করেছে। তুলে নিয়ে গেছে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক নেজামউদ্দিন রাসেলকে। সাম্প্রতিক অতীতে দেশের কোনও ব্যাংকে এমন ডাকাতির ঘটনা দেখা যায়নি। পার্বত্যাঞ্চলের এই ব্যাংকটিতে হানা দেওয়া দলটি পাহাড়ি সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্য বলে স্থানীয়দের দাবি। সংগঠনটি স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। তাদের পক্ষ থেকে ডাকাতির বিষয়ে এখনও কোনও বক্তব্য আসেনি।
ডাকাতির পর পুলিশ ও সেনাসদস্যরা ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা গেছেন ঘটনাস্থলে।
* যেভাবে ডাকাতি
মঙ্গলবার (৩ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৮টার পর উপজেলা সদরের সোনালী ব্যাংক শাখাটিতে ডাকাতরা হানা দেয় বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছে।
রুমা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মারমা স্থানীয়দের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, তারাবির নামাজ চলার সময় শতাধিক জন চতুর্দিকে ঘেরাও করে সবার মোবাইল কেড়ে নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে। তারা নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যের অস্ত্র লুট করে ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায়।
ব্যাংকটির ক্যশিয়ার উথোয়াইচিং মারমা ডাকাতির সময় ডরমিটরির বাইরে যুব উন্নয়ন অফিসের পাশে চায়ের দোকানে ছিলেন।
তিনি বলেন, “মুখে কালি লাগানো অপরিচিত তিনজন লোক অস্ত্রের মুখে দাঁড় করায় এবং আমার শরীর তল্লাশি করে পকেটে থাকা ১৫০০ টাকা এবং ব্যাংকের চাবি নিয়ে নেয়।”
জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুলিশ ও সেনাসদস্যরা এলে উথোয়াইচিং ব্যাংকে গিয়ে দেখেন, অফিস তছনছ হয়ে আছে।
ব্যাংকের পাশের মসজিদে তারাবির নামাজের সময় ডাকাত দল হানা দিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থাপককে তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, রাত সাড়ে ৯টায় তারাবির নামাজ পড়ার সময় একদল সশস্ত্র লোক মসজিদের সবাইকে জিম্মি করে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কে, তা জানতে চায়। তখন সবাই চুপ করে ছিল। এক পর্যায়ে তারা ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে খুঁজে বের করে তাকে নিয়ে ব্যাংকে ঢোকে। তারা ব্যাংকের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে। লুট করে যাওয়ার সময় ম্যানেজার নেজামউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে যায়।
ডাকাতরা চলে যাওয়ার পরপরই সেখানে সাংবাদিকসহ উৎসুক মানুষের ভিড় জমে। ব্যাংক কর্মকর্তা, আহত নিরাপত্তারক্ষীও সেখানে ছিলেন। তবে ভয়ে কেউ কিছু বলতে চাইছিলেন না।
* কতটি অস্ত্র লুট হয়েছে
ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তার জন্য সবসময়ই আনসার ও পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে। পার্বত্যাঞ্চলেও ব্যাংকটিতেও তারা ছিল।
রুমার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারুল আলম জানান, পুলিশ ও আনসার সদস্যদের মারধর করে মোট ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায় ডাকাত দল।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন সাংবাদিকদের জানান, পুলিশের ৮টি চাইনিজ রাইফেল, দুটি এসএমজিসহ মোট ১০টি অস্ত্র এবং ৩৮০ রাউন্ড গুলি, আনসারের চারটি শটগান এবং ৩৫ রাউন্ড গুলি লুট হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, রুমা শাখা বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ার সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারা থাকে। পাশাপাশি ব্যাংকের নিজস্ব অস্ত্রধারী নিরাপত্তাকর্মীও ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসীদের হামলায় তারা টিকতে পারেনি।
* কত অর্থ খোয়া গেছে
ব্যাংকটি থেকে কোটি টাকা লুট হয়েছে বলে ব্যাংককর্মীদের ধারণা, তবে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু এখনও জানানো হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, ঈদ ও বৈসাবিকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও বোনাস দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সকালেই ২ কোটি টাকার মতো রুমা শাখায় আসে। এই টাকার অধিকাংশই খোয়া গেছে।
ক্যাশিয়ার উথোয়াইচিং মারমা বলেন, তার জানামতে ভল্টের ভিতর ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জমা ছিল। ভল্টের দুটি চাবির মধ্যে তার কাছে একটি এবং ম্যানেজার নেজামউদ্দিনের কাছে আরেকটি চাবি ছিল।
দুটি চাবিই ডাকাতদের হস্তগত হওয়ায় পুরো অর্থই তাদের লুট করার সুযোগ ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, “ব্যাংকের ভল্ট চেক করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রাইমসিন টিম আসলে বোঝা যাবে, কত টাকা খোয়া গেছে কিংবা খোয়া গেছে কি না?”
* ডাকাতিতে কারা?
বুধবার দুপুর গড়ালেও এখনও ডাকাতির ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি বলে জানান রুমা থানার ওসি মো. শাজাহান।
সকালে জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, “কে বা কারা করেছে, ক্রাইমসিন টিম এলে তারা ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে তদন্ত করবে, সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।” ব্যাংক ম্যানেজারকে উদ্ধার করার জন্য পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনীর অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, হামলাকারীদের কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্য। রুমা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লাচিং মারমা স্থানীয়দের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, কুকি-চিনের শতাধিক সদস্য ব্যাংকে হামলা চালিয়েছিল।
ভারপ্রাপ্ত ইউএনও দিদারুল আলম বলেন, আহতরা তাকে বলেছে যে ডাকাতরা ছিল কেএনএফ সদস্য।হামলায় কুকি-চিনের জড়িত থাকার কথা শুনেছেন বলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমও জানিয়েছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। ব্যাংক শাখাটি বর্তমানে সেনাবাহিনী ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।
* কুকি-চিন কারা?
পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয়টি নৃ-গোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবিতে গড়ে ওঠা সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট-কেএনএফ। তাদের সামরিক শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি- কেএনএ। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের আগের সংগঠনগুলো সন্দেহের চোখে দেখে কেএনএফকে। এই সংগঠনটিও পাহাড়ে চাকমা আধিপত্যের বিরোধিতা করে। কেএনএফের নেতা হিসাবে বম জনগোষ্ঠীর নাথান বমের নাম আসে, সেই কারণেই সংগঠনটি বম পার্টি নামে পরিচিত। কয়েক বছর আগে সংগঠনটি আলোচনায় উঠে আসে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের ‘যোগসাজশের’ কারণে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘরছাড়া একদল তরুণের সন্ধানে নেমে র‌্যাব জানতে পারে, তারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন একটি জঙ্গি দলে ভিড়েছে। আর পাহাড়ে তাদের আশ্রয় এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ। ২০২২ সালে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে এই খবর দিয়েছিল। এরপর জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমায় অভিযান চালায় র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে সেনাসদস্যের প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে। এই সংঘাতের মধ্যে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে এই বছরের শুরু অবধি রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদমে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
এদিকে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি আলোচনার উদ্যোগও নিয়েছে স্থানীয় সরকারি প্রশাসন। এজন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। গত মাসে কেএনএফের সঙ্গে শান্তি কমিটির দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়।
রুমার ডাকাতির বিষয়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের কোনও বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি।