জনমনে ভাবনা, কে হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী?

162

॥ নন্দন দেবনাথ, মিল্টন বাহাদুর ॥
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সারা দেশের ন্যায় এই তিন সংসদীয় আসনে ও ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন তিনটিতে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের তিনজন।
আর এতে করে জনমনে ভাবনা কে হচ্ছেন পার্বত্য মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে। দীপংকর তালুকদার, বীর বাহাদুর না কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এই নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে না না গুনজন। পার্বত্য মন্ত্রনলয়ের দায়িত্ব নিতে তিনই দারুন লবিং শুরু করেছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে কে আসনে সেটা দেখার বিষয়। বুধবার সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ হলে বৃহস্পতিবার মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হবে আর মন্ত্রীসভার বৈঠকে সেটি চূড়ান্তভাবে জানা যাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম খ্যাত রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের মনোনীত তিন প্রার্থী বিপুল ভোটে এবারের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তিন পার্বত্য জেলায় সব চেয়ে বেশী ভোট পেয়েছেন রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার। ৭ জানুয়ারী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৯নং রাঙ্গামাটি আসনে নৌকা প্রতীকে তিনি ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৫০৪ ভোট পেয়ে ৫ম বারের মত সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হন দীপংকর তালুকদার। তিনি গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার ভোট বেশী পেয়েছেন।
১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পর থেকে তিন পার্বত্য আসন থেকে সাধারণত দেয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব। তবে এবার কার ভাগ্যে জুটছে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, এ নিয়ে চলছে তিন জেলায় সাধারণ মানুষের মাঝে গুঞ্জন। চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে।
পাহাড়ের জনগনের ভালোবাসায় ২৯৮ নং আসন খাগড়াছড়ির কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ২ লাখ ২০ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়েছেন, ২৯৯ নং আসনে দীপংকর তালুকদার ভোট পেয়েছেন রাঙ্গামাটি ২ লক্ষ ৭১ হাজার ৫০৪ ভোট, ৩০০ আসনে বান্দরবান বীর বাহাদুর পেয়েছেন ১ লাখ ৭২ হাজার, ৬৭১ ভোট।
খাগড়াছড়ি ২৯৮ আসনে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বিজয়ী হন। ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শরণার্থী বিষয়ক (টাস্কফোর্স) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাঙ্গামাটি ২৯৯ আসন হচ্ছেন একটি জঠিল আসন। বরাবরই দীপংকর তালুকদারকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়েছে। যত ঘাত প্রতিঘাত এসেছে এই আসনটির উপরই এসেছে। বরাবরের মতো আওয়ামীলীগ দলকে ধরে রেখেছেন দীপংকর তালুকদার। দীপংকর তালুকদার ৭ম বার নির্বাচন করে পঞ্চমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে ২০০১ সালে আঞ্চলিক সংগঠন জেএসএস এর সমর্থন নিয়ে আওয়ামীলীগকে হারায় বিএনপির মনি স্বপন দেওয়ান। ২০১৪ সালে বিএনপির সমর্তন নিয়ে জেএসএসের উষাতন তালুকদার দীপংকর তালুকদারকে পরাজিত করে। পরে ২০১৮ সালে হাড্ডা হাডি লড়াইয়ের মাধ্যমে সিটটি আবারো শেখ হাসিনাকে উপহার দেয় দীপংকর তালুকদার।
অপরদিকে বান্দরবান ৩০০ আসনে বীর বাহাদুর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালে এমপি নির্বাচিত হন। এর মধ্যে তিনি ২০০৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য প্রয়াত কল্প রঞ্জন চাকমা। পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির সরকারের আমলে রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য মনি স্বপন দেওয়ান উপমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ২০১৪ সাল থেকে টানা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন বান্দরবানের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশেসিং। শুরুতে প্রতিমন্ত্রী হলেও পরবর্তীতে ২০১৮ সালে পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে টানা নয় বছর ধরে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে। এবার জিতে যাওয়ায় আশা রেখেছেন পাহাড়ের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ দীপংকর তালুকদার। সমস্ত জল্পনা-কল্পনা তাকে ঘিরেই।
তবে সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, দীপংকর তালুকদার শেখ হাসিনার প্রিয় মুখ। দীপংকর তালুকদারকে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না দেয়া হয় তখন অন্য কোন মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রির দায়িত্ব হয়তো তাকে দেয়া হবে। সে আশাবাদ সাধারণ জনগনের।
রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর বলেন, আমরা রাঙ্গামাটিবাসী পাহাড়ী বাঙালী ঐক্যের প্রতীক দীপংকর তালুকদারকে পার্বত্য মন্ত্রনালয়ের পুর্ণমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলেও ২০১৪ সনের পর রাঙ্গামাটিবাসী মন্ত্রিত্ব পাওয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। দীপংকর তালুকদারের আমলে সুষম উন্নয়ন হয়েছে দাবি করে তিনি নেত্রীর কাছে মন্ত্রীসভা গঠনের সময় দীপংকর তালুকদারকে পুর্ণমন্ত্রী করার দাবি জানান। তিনি আরো বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় এবার সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন দীপংকর তালুকদার।
দীপংকর তালুকদার ১৯৫২ সালে ১২ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঊনসত্তর ও সাতাশি’র গনঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে তিনি দু’বার কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০২ সালে তিনি পরপর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পদে অধ্যাবধি উক্ত পদে রয়েছেন। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৮ ও ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালসহ পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ত্যাগ-তীতিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদ পেলে জনমনে ভাবনা নেতাকর্মীদের চাওয়া হয়তো দীপংকর তালুকদার এবারে পেতে পারেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব পদ।
অপরদিকে ৩০০নং বান্দরবান আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৬৭১ ভোট পেয়ে ৭ম বারের মত সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন বীর বাহাদুর উশৈসিং। ১৯৮৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এম, এ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন। ১৯৯৭ সালে ২ রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ২৯৮ নং খাগড়াছড়ি আসনের সাংসদ কল্পরঞ্জন চাকমাকে সর্বপ্রথম পার্বত্য মন্ত্রী করা হয়েছিল। এরপর থেকে সবাই ছিলেন উপমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। সর্বশেষ ১৮ বছর পর ২০১৯ সালে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ৩০০নং বান্দরবান আসনের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং। তাঁর অবস্থান থেকে তিনি ও হয়তো ধরে রাখতে চেষ্টা করবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব পদটি।
২৯৮ নং খাগড়াছড়ি আসনে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নৌকা প্রতীকে ২ লক্ষ ২০ হাজার ৮৭৬ ভোট পেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩য় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শিক্ষা জীবনে তিনি বি, এ ডিগ্রি লাভ করেন। শুরু থেকে তিনি খাগড়াছড়ি জেলায় রাজনীতির সাথে অতোপ্রতো ভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর অবস্থান থেকে তিনি ও হয়তো ধরে রাখতে চেষ্টা করবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব পদটি। তবে শেষ হাসি কে হাসবেন এখন দেখার বিষয়।