শুরু হলো শারদোৎসবঃ ঢাক-ঢোলক-কাঁসরে পড়েছে কাঠি

192

॥ নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
ঢাক-ঢোলকে পড়েছে কাঠি। আলো-সানাই-শঙ্খ আর কাঁসার রোয়াবে হিন্দু নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের প্রাণ আনচান করছে। মৃন্ময়ী থেকে আনন্দময়ীর রূপদান পর্বের সমাপ্তি। হিন্দুদের বিশ্বাসে কৈলাসশিখর ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা দুর্গার অকালবোধন হয়েছে গতকাল। আকাশে-বাতাসে এখন শারদ উৎসবের বিন্দাস শিহরণ। শিল্পী তার তুলির নিপুণ আঁচড়ে বর্ণাঢ্য বিভায় উদ্ভাসিত করে তুলেছে মহিষাসুর মর্দিনীকে। প্রতিমার অধিষ্ঠান হয়েছে মণ্ডপে। আজ খুলে যাবে তার আয়ত চোখের পলক। অসুরবধে চক্র, গদা, তির, ধনুক, খড়্গ-কৃপাণ-ত্রিশূল হাতে মাতৃরূপেন অসুরদলনী দেবী হেসে উঠবেন। ধূপের ধোঁয়ায় আজ সায়ংকালে ঢাক-ঢোলক-কাঁসর-মন্দিরার চারদিক কাঁপানো নিনাদ আর পুরোহিতদের জলদকণ্ঠে :‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নম নম’ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দূর কৈলাস ছেড়ে মা পিতৃগৃহে আসবেন ঘোটকে। ফল ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’। অর্থাৎ, ঘোটকে আগমনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রোগ-শোক, হানাহানি-মারামারি, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা প্রকাশ পাবে। বিজয়া দশমীতে এয়োস্ত্রীদের দেবীবরণ ও সিঁদুর খেলার পর বিদায় নেবেন ঘোটকেই।
বিশুদ্ধ হিন্দু সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে শুক্রবার (২০ অক্টোবর) পূর্বাহ্নে ৯-৫৭ মধ্যে ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ, সায়ংকালে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাস। বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের পর ষষ্ঠী তিথির সূচনা ঘটে। শুক্রবার রাত ৮টা ২৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড অব্দি তিথি থাকবে। অতঃপর শুরু হবে মহাসপ্তমী তিথি। আগামীকাল মহাসপ্তমীর প্রভাতে ঢাক-ঢোলক-কাঁসর বাজিয়ে কলাবউ স্নান ও আদরিণী উমার সপরিবারে তিথি বিহিত পূজা। রবিবার মহাষ্টমীতে অনুষ্ঠিত হবে কুমারী পূজা। সোমবার সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে নবমী বিহীত পূজা। পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৭টায় পূজা সমাপণ ও পরে দর্পণ বিসর্জন-শান্তিজল গ্রহণ। সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন, অর্থাৎ দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন পূর্ণিমায়; এই দিন কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত এবং সাম্বৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন।
দুর্গাপূজা মূলত পাঁচ দিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। কোনো কোনো পরিবারে অবশ্য পনেরো দিনে দুর্গোৎসব পালনের প্রথা আছে।
এদিকে শারদীয় দুর্গোৎসবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় এ বছর ১০ উপজেলায় ৪৩টি পূজামন্ডপে দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ১৪টি, কাপ্তাই উপজেলায় ৮টি, রাজস্থলী উপজেলায় ৪টি, কাউখালী উপজেলায় ৪টি, নানিয়ারচর উপজেলায় ১টি, জুরাছড়ি উপজেলায় ১টি, বিলাইছড়ি উপজেলায় ২টি, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ৫টি, লংগদু উপজেলায় ৩টি ও বরকল উপজেলায় ২টি পূজা মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পূজা উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দূর্গাপূজা চলাকালীন সময়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাসহ সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং এর জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন ছাড়াও প্রতিটি পূজামন্ডপে সার্বক্ষনিক পুলিশের টহলের পাশাপাশি আনসার বাহিনীর সদস্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া পূজামন্ডপে সার্বক্ষনিকভাবে নিরাপত্তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে।
যে সব মন্দিরে পূজা অনুষ্ঠিত হবে তার মধ্যে রয়েছে, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় শ্রী শ্রী গীতাশ্রম মন্দির রিজার্ভ বাজার, আইচ ভবন রিজার্ভ বাজার, শ্রী শ্রী শারদীয় দূর্গোৎসব নতুন জালিয়া পাড়া, রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি, শ্রী শ্রী নারায়ন মন্দির পৌর কলোনী, পুরাতন বাস ষ্টেশন, শ্রী শ্রী রক্ষাকালী বাড়ী, তবলছড়ি, শ্রী শ্রী দুর্গা মাতৃমন্দির স্বর্ণটিলা, শ্রী শ্রী শিতলা মন্দির আসামবস্তী, শ্রী শ্রী সার্বজনীন দূর্গোৎসব গর্জনতলী, শ্রী শ্রী দুর্গা মাতৃ মন্দির কাঠালতলী, শ্রী শ্রী দশভূজা মাতৃমন্দির কালিন্দীপুর, শ্রী শ্রী সনাতন যুব একতা সংঘ কলেজ গেইট, শ্রী শ্রী কালী মাতৃমন্দির ভেদভেদী ও শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মন্দির কেইল্যা মুড়া। কাপ্তাই উপজেলায় শ্রী শ্রী কর্ণফুলী দুর্গা মাতৃমন্দির ব্রীক ফিল্ড রোড কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, শ্রী শ্রী জয় কালী মন্দির লক গেইট কাপ্তাই, শ্রী শ্রী হরি মন্দির কেপিএম চন্দ্রঘোনা, শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দির চন্দ্রঘোণা মিশন চন্দ্রঘোণা, শ্রী শ্রী আদি নারায়ন বৈদান্তিক গীতা মন্দির চন্দ্রঘোনা, শ্রী শ্রী ত্রিপুরা সুন্দরী কালী মন্দির রাইখালী বাজার, রাজস্থলী উপজেলায় শ্রী শ্রী হরি মন্দির, রাজস্থলী বাজার, শ্রী শ্রী দক্ষিণনেশ্বর কালী মন্দির বাঙ্গালহালিয়া,কাউখালী উপজেলায় শ্রী শ্রী গীতা মন্দির, ঘাগড়া, শ্রী শ্রী গীতা মন্দির কাউখালী সদর, শ্রী শ্রী গীতা মন্দির বেতবুনিয়া, শ্রী শ্রী সার্বজনীন দূর্গোৎসব বেতবুনিয়া।নানিয়ারচর উপজেলায় শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির নানিয়ারচর, শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির বুড়িঘাট, জুরাছড়ি উপজেলায় শ্রী শ্রী হরি মন্দির জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি উপজেলায় শ্রী শ্রী করুণাময়ী কালী মন্দির বিলাইছড়িবাজার, বাঘাইছড়ি উপজেলায় শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মন্দির বাঘাইছড়ি, শ্রী শ্রী হরি মন্দির করেঙ্গাতলী, শ্রী শ্রী জগন্নাথ মন্দির দুরছড়ি।লংগদু উপজেলায় শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির লংগদু সদর, শ্রী শ্রী হরি মন্দির মাইনীমুখ ও বরকল উপজেলায় শ্রী শ্রী হরি মন্দির বরকল সদর। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রাঙ্গামাটির সভাপতি অমর কুমার দে জানান, এবছর রাঙ্গামাটি জেলায় ৪৩টি পূজামন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। সকল মন্দিরে পূজা উদযাপনের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
মাইক ও আতশবাজি-পটকা ব্যবহার না করার আহ্বান
এদিকে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির পক্ষ থেকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে সার্বিকভাবে মায়ের অর্চনাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, প্রতিমা তৈরি থেকে পূজা সমাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি পূজামণ্ডপে নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সংশ্লিষ্ট মণ্ডপ কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। পূজা মন্দিরে নারী ও পুরুষের পৃথক যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিজস্ব নারী-পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক রাখতে হবে। স্বেচ্ছাসেবকদের নামের তালিকা (মোবাইল নম্বরসহ) জেলা ও কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। সন্দেহভাজন দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা এবং নারী স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে নারী দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে। উচ্চ শব্দের কারণে বিরক্তি উদ্রেককারী মাইক-পিএসেট ও আতশবাজি-পটকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। ভক্তিমূলক সংগীত ছাড়া অন্য কোনো গান বাজানো থেকে বিরত থাকতে হবে। কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এরূপ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার কথাও নির্দেশনায় বলা হয়।