॥ রুমা প্রতিনিধি ॥
ছোট ছোট তিন সন্তানে মা-মেরী ত্রিপুরা (২৪)। সাপের কামড়ে মারা যায় স্বামী বীরেন্ট ত্রিপুরা। তাদের আয়ের একমাত্র সম্বল ছিল চা দোকানটি। স্বামী মারা যাওয়ার তিন-চার মাসের মাথায় বন্যায় চা-দোকানটি পানিতে তলিয়ে ভেঙ্গে দেয়। এতে বাসস্থান ও দৈনন্দিন খাবার যোগার কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও জীবন বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মেরী ত্রিপুরার।
বান্দরবানের রুমা সদর ইউনিয়নের ১নং ঘাটে দোকানে চা বিক্রি করেন মেরী ত্রিপুরা। এ প্রতিবেদক শুক্রবার (৬ অক্টোবর) বিকালে তাঁর দোকানে গিয়ে কথা বলেন।
মেরী ত্রিপুরা বলেন, দোকানে সামনে অংশে চা দোকান। পিছনে অংশে রান্না ঘর। এ চিপা মাচাংয়ে আমার স্বামী, ছেলে, মেয়ে ও আমি এক সাথে ঘুমাইতাম।
মেরী ত্রিপুরা বলেন গত জুন মাসে তৃতীয় সপ্তাহ একদিন রাতে ঘুমান্ত অবস্থায় আমার স্বামী বাম হাতের বাহতে অজ্ঞাত এক সাপ কামড় দেয়। তাৎক্ষণিক প্রচন্ড ব্যথায় হাতটি ফুলে যায়। প্রয়োজনমত হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় স্থানীয় ফার্মেসীতে চিকিৎসা নেয়া। কয়েকটি ইনজেকশন দিয়েও ভাল না হলে, বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় পরে চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য। পথে-ই মারা যায়।
মেরী ত্রিপুরা বলেন, আমার স্বামী মরে যাওয়ার পর দোকানও বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। স্বামী অনুপস্থিতিতে একদিকে এনজিও কিস্তির জ্বালা, অন্যদিকে ঘরে কী খাব, কী না করব, তা কোনো কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থায় আগস্ট মাসে প্রথম দিকে প্রবল বৃষ্টিপাতের বন্যা শুরু হয়। বাড়তে থাকে পানি। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য রাস্তার ওপারে ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ভবনে দু’তলায় আশ্রয় নেন বিধবা মেরী ত্রিপুরা পরিবারের সদস্যরা। সেখানে দুইদিন থাকার পর ওই ভবনে দু’তলায় পৌঁছে যায়-পানি। ততক্ষণে মেরী ত্রিপুরা দোকান-বাড়ি সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিল।
এদিকে ভবনের বারান্দায় সব লোহার গ্রিল। বের হয়ে যাওয়া কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে দু’তলায় ফ্লোরেও বন্যার পানি ওঠা শুরু করে। মেরী ত্রিপুরা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে মা ও ছেলে মেয়েরা চিৎকারে কান্নাকাটি।
তিনি বলেন রুমা সাঙ্গু সরকারি কলেজে ডমং মার্মাসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী সাঁতার কেটে এসে ওই ভবনের বারান্দার গ্রিল কেটে বের করে তাদের নৌকায় করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়।
মেরী ত্রিপুরা বলেন বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর এমনিতে দোকানতো গেছে। আগের ভবনে আশ্রয় নিতে শুরু করি। তখনই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, কী খাব, কি কাজ করে বাচাদের লালন পালন করব। ওই সময় বিজিবি ও সেনাবাহিনীরা চাল, ডাল ও তেল দিয়েছিল। ওইসব খাবার খেয়ে সকাল-বিকাল দোকানে কাদা মাটি সরিয়ে নিচ্ছিলাম। ঠিক তখন আমাদের মেম্বার অংচিন (অংসিংনু মারমা) জেলা পরিষদ থেকে তাকে পাঁচশ টাকা দেয়ার কথায় জানায়। কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না মেরী ত্রিপুরা।
তিনি বলেন জেলা পরিষদ থেকে অনুদান ৫০০০/টাকা দিয়ে দোকানটা কোনো রকম ঠিক করিয়েছি। তারপর ভেবে পাচ্ছিলাম না, দোকানের মালামাল তুলতে কোথায় থেকে টাকা পাব। ঠিক ওইসময় কারিতাস ও হিউম্যানিটারিয়ান সংস্থা আমার নাম তালিকায় নিয়ে নগদ পাঁচ হাজার পাঁচশত টাকা ও ত্রাণ সামগ্রি দিলেন। এই টাকা অন্য কোথাও খরচ করিনি। সব টাকা দোকানে বিক্রির মালামাল কিনে নিয়েছি।
এখন প্রতিদিন চা- বিস্কুট ও পান বিক্রি হয়- এক থেকে দেড় হাজার টাকা। দিন শেষে হাতে লাভ থাকে তিন-চারশ টাকা। এটার বাইরে সব টাকা কোম্পানি নিয়ে যায় আর কিস্তি দিয়ে ফেলি। এভাবে চলছে-তিন সন্তানের মা বিধবা মেরী ত্রিপুরার জীবন বাঁচা লড়াইয়ের সংগ্রাম।