॥ বান্দরবান প্রতিনিধি ॥
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৫৫ ও ৫৬ নাম্বার সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে বিদেশী সিগারেট ও মদ চোরা চালানে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালামের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিলুপ্ত ম্রো ন্যাশনাল পার্টির (এমএনপি) সাবেক কমান্ডার মেনরুং ম্রো।
বুধবার (৩০ আগস্ট) বিকালে আলীকদম উপজেলা সদরের একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবী করেন মেনরুং ম্রো।
সংবাদ সম্মেলনে বিলুপ্ত গেরিলা সংগঠন এমএনপির সাবেক কমান্ডার মেনরুং ম্রো বলেন, আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম দীর্ঘদিন ধরে ম্রো ও মার্মা শ্রমিক ব্যবহার করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বিদেশী সিগারেট, মদ ও গরু চোরাচালান করে আসছে। এসবের প্রতিবাদ করার কারণে উপজেলা চেয়ারম্যান কালাম প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন দাবি করেন মেনরুং ম্রো।
মেনরুং ম্রো অভিযোগ করে বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে আত্মসমর্পিত এমএনপি সদস্যরা শান্তিপুর্ণভাবে সহাবস্থান করলেও আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম বিগত কয়েক বছর ধরে এমএনপির সাবেক সদস্যদের আর্থিক প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পিলার ৫৫ ও ৫৬ নাম্বার এলাকা দিয়া গরু ও মাদক চোরাচালান করে আসছে। এক পর্যায় বাধ্য হয়ে ২০২২-২০২৩ সালের বিভিন্ন সময় মেনরুং ম্রো দলবলসহ উপজেলা চেয়ারম্যান কালাম নিয়োজিত হয়ে গরু ব্যবসায়ীদের গরুগুলো মসল্লা পাড়া ও তৈন খালের দু’টি পয়েন্টে আটকানো শুরু করেন। বিনিময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও তার সহযোগি মোস্তফা প্রতি গরু থেকে ১৫০০-২০০০ টাকা চাঁদা আদায় করতেন। এই চাঁদা থেকে গরু প্রতি ৫০০ টাকা হারে মেনরুংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত ম্রো শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম চাঁদার ভাগ থেকে ৬ লাখ টাকা দিলেও মেনরুংয়ের শ্রমিকদের পাওনা ২১ লক্ষ টাকা দেয়নি। এনিয়ে বিভিন্ন সময় কথা কাটাকাটি হয়।
মেনরুং বলেন, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান বিদেশী উরিস সিগারেট ও মদ আনার অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এই কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছে মুরুংদের। তিনি নিজের পদ-পদবী ব্যবহার করে আলীকদম-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক দিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত হতে চোরাচালানী পণ্য বাংলাদেশে এনে দেশের নানান স্থানে পাচার করেন। চোরাইপথে আনা এইসব চোরাচালানী পণ্যের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের উরিস সিগারেট, মদের মধ্যে রয়েছে ঈগল, ব্যান্ড রয়েল, হুইস্কি ও মারডালাই রাম।
বক্তব্যে আরো বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম রাত-বিরাতে আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে সবসময় যাতায়াত করেন। একজন পদস্থ জনপ্রতিনিধি হয়েও গভীর রাতে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তার অবাধ যাতায়াত প্রশ্নবিদ্ধ। মিয়ানমার থেকে আনা চোরাচালানের মাদকগুলি তিনি আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক পথ ব্যবহার করে রাতের বেলায় পাচার করেন। মাঝে মধ্যে সড়কপথ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে মাতামুহুরী নদীর ঠান্ডারঝিরি নামক স্থানের নদী ঘাট হতে নৌপথে তৈনখালের আমতলী লংঘাটে নামিয়ে আশ্রায়ণ প্রকল্প রাস্তা ব্যবহার করে মাদকদ্রব্যগুলি বাইরে পাচার করে থাকেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ী বিধায় উনার গাড়ী কেউ তল্লাশি করে না, সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি অবৈধ পণ্য পাচার করেন।
মেনরুং বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট দিনগত দিবাগত রাতে উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালামের নেতৃত্বে উনার ৩টি গাড়ীতে করে মিয়ানমার হতে প্রচুর পরিমাণ উরিস সিগারেট আনা হয়েছে। তখন আমিসহ আমার সঙ্গী আরো ৬ জন পাড়াবাসীকে নিয়া পাওনা টাকার জন্য আমরা গাড়ির সামনে গিয়া দাড়াই। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম নিজের মালিকানাধীন গাড়ি থেকে নেমে আমাদেরকে সরে যেতে বলেন এবং তর্জন-গজন করে আমার টি-শার্টের কলার ধরে টানাহেছড়া করেন। আমি মুরুং সম্প্রদায়ের লোকজন অবৈধ মাদক ব্যবসা কেন ব্যবহার করছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে হুমকী দেন এবং আমাকে টেনে বিদেশী সিগারেট থাকা গাড়িতে তুলে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। আমার সঙ্গীদের প্রতিরোধের মুখে উপজেলা চেয়ারম্যান আমাকে গাড়িতে তুলতে পারে নাই। আমাকে জোর করে গাড়ীতে তোলায় বাধা দেওয়ার সময় আমার সাথে থাকা মাংলে ম্রোকে উপজেলা চেয়ারম্যানের গাড়ি থেকে নেমে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি সজোরে আঘাত করলে সে গুরুতর আঘাত পায়। এই সময় উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম উচ্চস্বরে হুমকী দিয়ে আমাকে অস্ত্র ও মাদকে ফাঁসাবেন। আমি তার কাজে বাঁধা দিয়েছি তাই।
এই সময় স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিসহ প্রশাসনকে ঘটনা জানালে ২৮ আগস্ট দিবাগত গভীর রাত আনুমানিক ২টায় আলীকদম ব্যাটালিয়ান (৫৭ বিজিবি) বিজিবি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখন আমার প্রতিবেশী শ্রমিক বুবশে মার্মা (৩০) টহলরত বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদেরকে ঠান্ডারঝিরি নামক স্থানে উপজেলা চেয়ারম্যানের লোকজনের লুকিয় রাখা অবৈধ উরিস সিগারেটগুলি দেখিয়ে দিলে রাত আনুমানিক ২.২০ ঘটিকার সময় বিজিবি এবং পুলিশ সদসদের যৌথ অভিযানে নয়াপাড়া ইউনিয়নের ঠান্ডারঝিরি নামক স্থান হইতে ১১,০০০ প্যাকেট বিদেশী উরিস সিগারেট উদ্ধার করে। যার আনুমানিক মূল্য ৩৩ লাখ টাকা।
মেনরুংয়ের দাবী, উদ্ধার হওয়া সিগারেটগুলি বিজিবির পক্ষ থেকে মালিকানাবিহীন দেখানো হলেও এইসব অবৈধ সিগারেট উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালামের মালিকানাধীন। যার সাক্ষী হিসেবে আছেন স্থানীয় ম্রো ও মার্মা শ্রমিকরা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, গত ২৮ আগস্ট রাত সাড়ে নয়টার দিকে আমি খবর পাই যে, সাবেক এমএনপি কমান্ডার মেনরুং ম্রোর নেতৃত্বে আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কের মেরিনচর এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আমি যাই। পুলিশকেও ঘটনাটি জানাই। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ যান। আমি সেখান থেকে চলে আসি। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সত্য নয়।
এদিকে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কালামকে প্রধান আসামী করে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে মারধর ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে মেনরুং ম্রোর সহচর মাংলে ম্রো বাদী হয়ে আলীকদম থানায় বুধবার (৩০ আগষ্ট ) একটি মামলা করেন বলে জানান আলীকদম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার মো.তবিদুর রহমান।