ঘুরে আসুন এখনি বিলাইছড়ির মায়াবী গাছকাটাছড়া ঝর্ণায়

356

সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, বিলাইছড়িঃ-প্রকৃতির রানী বলা হয় রাঙ্গামাটিকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ঘেরা বিলাইছড়ি উপজেলাও। এ উপজেলার মোট আয়তন ৭৪৫.১২ বর্গকিলোমিটার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৫০০০ হাজারের উপরে। ভারত ও ময়ানমার দুই দেশের সীমানা রয়েছে এই উপজেলায়। রয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাসিন্দা। সামাজিক সংস্কৃতিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আচরন, ভিন্ন ভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার-দাবারে রয়েছে ভিন্নতা। তাদের বসবাস পাহাড়ের নীচে, নদীর ধারে, ছড়ার পারে কিংবা সুউচ্চ পাহাড়ে। এজন্য বিলাইছড়ি উপজেলা তো নয় যেন এক মায়াবী স্বর্গ। তাই দেখতে জীবনে একবার হলেও ঘুরে আসুন এই উপজেলায় এবং ঝর্ণা সহ বিলাইছড়ি প্রকৃতি।
এই উপজেলার প্রকৃতি যেন আপনাকে ডাকছে, বলছে দেখ আমাকে কেমন লাগছে। আমিও তোমাদের সঙ্গে মিতালী করতে চাই। হাল-বিল, নদ-নদী, পাহাড়, লেক সবকিছু যেন একসাথে মিলবন্ধন। অতিথি পরায়ণ বিলাইছড়িবাসীও। কর্ণফুলি লেক থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ৫টি শাখা নদী তার মধ্যে ১ টি নদী হলো রাইংখ্যং নদী। সেই নদীর উৎস হচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়ের ঝিঁড়ি, ঝর্ণা, ছড়া থেকে। পাহাড়ের রয়েছে শত শত ছোট-বড় অনেক ঝর্ণা। তেমনিভাবে বিলাইছড়িতে রয়েছে অনেক বড় বড় ঝর্ণাও। যেমন-“নকাটাছড়া ঝর্ণা”, ছিনামৌন “স্বর্গপুর ঝর্ণা” “গাছকাটাছড়া ঝর্ণা “মুপ্যাছড়া ঝর্ণা, “ধূপপানী ঝর্ণা”-সহ অসংখ্য ঝর্ণা দেখার প্রকৃত সময়। এজন্য ঝর্ণার জন্য বিখ্যাতও বলা যাবে বিলাইছড়ি উপজেলাকে।
অন্য ঝর্ণা থেকে সম্পুর্ন আলাদা দেখতে সুন্দর এই “গাছ কাটাছড়া ঝর্ণা”। এই ঝর্ণাটি বিলাইছড়ি ও কাপ্তাই উপজেলার শেষ সীমানায় অবস্থিত।
প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু হতে রিমঝিম রিমঝিম করে সবসময় বৃষ্টির মত পানি পড়তে থাকে। ভিজলে মূহুর্তের মধ্যেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। চৈত্র মাসে খরা রোদেও কোন রকম পৌঁছাতে পারলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, ভুলে যায় ঝর্ণার পানি পরশ করলে। গ্রীষ্মকালেও তীব্র শীত অনুভূত হয় এ ঝর্ণায়। খুব বেশি ঠান্ডা অনুভুত হয়। শুভলং ঝর্না, হিমছড়ি, সীতাকুন্ড এবং মাধবকুন্ড অন্যান্য ঝর্ণার চেয়ে ও কোন অংশে কম নয়। হার মানাবে দেশের বেশ অন্যান্য বড় বড় ঝর্ণাকে। না দেখলে মিস করবেন।
নামের উৎপত্তিঃ গাছকাটা ছড়া ঝর্ণাকে স্থানীয়রা (স্থানীয় ভাষায়) বর্তমানে সাদারী ঝর্ণা,, অনেকে ধন্দো টাং-ও বলে। তবে স্থানীয় বয়স বৃদ্ধরা বেশিরভাগ ধন্দো টাং-বলে। কথিত আছে-জৈনক ঐ ব্যক্তি অর্থাৎ ধন্দো তঞ্চঙ্গ্যা জুম চাষ করার সময় তার পরমা সুন্দরী স্ত্রী কে নিয়ে লুই বা পলুই দিয়ে ঐ ঝর্ণায় মাছ, কাকঁড়া ও ব্যাঙাচি ধরতে গেলে পানির চাপে হোঁচট খেয়ে ঐ ঝর্ণা উপর থেকে একদম নীচে পরে গিয়ে মারা যায় বলে (৯০ বছর বয়সের) এক বৃদ্ধার মুখে শোনা গেছে।
তিনি বলেন-ধন্দো নামে ঐ ব্যক্তিটি জুমের পাকা ধান কাটার সময়ে শুকর ও মুরগী দিয়ে লুক্ষীকে পূজো দিয়ে পাড়া-পড়ঁশী নিয়ে আনন্দে প্রথম ভাত বা যেতাকে স্থানীয় ভাষায় “নয়াভাত” (যা নবান্ন উৎসবের মত) খাওয়ার আগে ঠিক সেই সময় অর্থাৎ জুমের নবান্ন সুগন্ধিযুক্ত ভাত আত্মীয়-স্বজনদের হরেক রকম তরকারি সঙ্গে ও মাছ, ইছা, শামুক, কাঁকড়া ও ব্যাঙাচি দিয়ে অথিতিদের আপ্যায়ন করাবেন বলে তিনি এই ছড়া- ঝর্ণায় যান। কিন্তু তার আর ফেরা হলো না। এজন্য তার নামা অনুসারে এটাকে ধন্দো টাং বললেও কোন ভাবে ভূল হবেনা।
ঝর্ণা রক্ষণাবেক্ষণ কমিটিঃ-বর্তমানে ঐ এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে ঝর্ণার একটি “ঝর্ণা রক্ষা কমিটি” গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি জয় সিন্ধু চাকমার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, গাছপালা কাটা হয়না বলে এই ঝর্ণা এখনো বেঁচে আছে। তাই আমরা ঝর্ণাকে রক্ষা করার জন্য প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি কমিটি গঠন করি এবং পর্যটক আসলে তাদেরকে আসার জন্য সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। এখনি প্রকৃত সময় ঝর্ণা দেখার। এই বর্ষা মৌসুমে এই ঝর্ণাকে আরো বেশি মনোমুগ্ধকর দেখায়, না দেখলে মিস করবেন। প্রতি বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখা যায় এই ঝর্ণা।
অবস্থানঃ– গাছকাটাছড়া ঝর্ণা বিলাইছড়ি উপজেলায় ১নং সদর ইউনিয়নে ৩নং কুতুব দিয়া ওয়ার্ডের গাছকাটাছড়া দোসরী পাড়ায় অবস্থিত। যা কাপ্তাই হরিনছড়া শেষসীমানা ও বিলাইছড়ি উপজেলার ১২২ কুতুবদিয়া মৌজার শেষ সীমানায় অবস্থিত। যেতে হলে কাপ্তাই হতে বিলাইছড়িতে নৌ-পথে আসার সময় সরাসরি যাওয়া যায় এবং বিলাইছড়ি সদর থেকেও তেমন দূরে নয়। কান্ট্রি বোটে বিলাইছড়ি হতে প্রায় ১ ঘন্টা নদী পথ এবং সেখান থেকে ১ ঘন্টার কিছু অধিক হাটলে পৌঁছা যাবে ঐ ঝর্ণায়। গাইডার পাওয়া যাবে।
কিভাবে যাবেনঃ-ঢাকা হতে ইউনিক, ডলফিন, শ্যামলী ও হানিফ প্রটারপ্রাইজ, বিআরটিসি কোচে করে রাঙ্গামাটির তবল ছড়ি নতুবা রিজার্ভ বাজার বোট সকাল ৭টা কিংবা বেলা ২টা এবং ৩টায় বিলাইছড়ির পথে লঞ্চ পাওয়া যাবে।অন্যদিকে ঢাকা হতে সরাসরি কাপ্তাই হয়ে বিলাইছড়িতে ইঞ্জিন চালিত লোকেল বোটে ভাড়া নেবে জন প্রতি ৭০ টাকা, রিজার্ভ ভাড়া হলে (কান্ট্রি বোটে) প্রতি বোট ১২০০/-টাকা নিবে।
থাকা ও খাবার ব্যবস্থাঃ- বিলাইছড়ি উপজেলায় নিলাদ্রী রিসোর্ট বাদেও রয়েছে বোর্ডিং হোটেল-মোটেল।ভাড়া পড়বে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত। সেখানে রাত্রি যাপনের পর ভোর সকাল ৮ টায় কান্ট্রি রিজার্ভ বোটে ভাড়া পড়বে মাত্র ১০০০-১২০০ টাকা। নতুবা কাপ্তাই উপজেলায় জেটিঘাটে রাত্রিযাপন করে সকাল ৭ টা রওনা দিয়ে সরাসরি যেতে পারেন।
যাওয়ার পথেঃ- রাস্তায় যাওয়া পথে পথে দেখা মিলবে নদীর দুইধারে পাহাড়, পাহাড়ি গ্রাম, দেখা মিলবে তংঘর-মাছাংঘর আরো দেখা মিলবে-বন্য হাতি, হরিন, বন মোরগ, বনবিড়াল, উড়ন্ত কাঠ বিড়ালি, শুকর, ময়না, ঘুঘু কোকিল, সহ অসংখ্য পশু-পক্ষির ও তাদের কলকাকলি। তবে জোঁকও রয়েছে। তারপরে দূর থেকে শোনা যাবে বিকট শব্দ। এ ঝর্ণাটি প্রাসারিত রয়েছে যা পাথরের মাঠ।স্থানীয় ভায়ায় বড় সাদারী বলে। যা এত বড় সাদারী অন্য কোন ঝর্ণাতে নেই।
গাছ ও বাঁশের ফাঁকে হাটার পথে ডানে মোড় নিলে ঘুরে দেখলে এবং সোজা তাকালে ঐ যে ঐযে করে, একটু একটু দেখা যাবে ঝর্ণা। পৌঁছাতে পারলে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। এবার ইচ্ছামত দেখা গোসল করা আর সেলফি নেওয়া। সঙ্গে প্রিয়জন পাশে থাকলে তো কথাই নেই। যা ছোঁয়া ও মনের আনন্দে দেখার পরে পুনরায় ফিরতে হবে বিকেলে, থাকার সু- ব্যবস্থা নেই।