যেসব কারণে বিশ্বরেকর্ড গড়ল পদ্মা সেতু

102

ডেস্ক রিপোর্টঃ-নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অবশেষে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। মেলবন্ধন ঘটিয়েছে পদ্মার দুই পাড়ের। শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, আমাজন নদীর পর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মায় সেতু নির্মাণ কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতভাগ সফল বাংলাদেশ।
বিশ্ব বিস্মিত যে, এমন খরস্রোতা নদীতে ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণে সফল বাংলাদেশ, তাও দাতাদের সহায়তা না নিয়ে দেশটির জনগণের টাকায়!
এদিকে এ সেতু নির্মাণে বেশ কয়েকটি বিশ্বরেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের ব্যবহারে পদ্মা সেতু গড়েছে বিশ্বরেকর্ড। সেতু বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ সেতু কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশ্বেরেকর্ড গড়েছে। নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ের ব্যবহারে পদ্মা সেতু গড়েছে বিশ্বেরেকর্ড। সেতু বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
গভীরতম পাইলঃ
খরস্রোতা পদ্মা নদীতে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। পানি প্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান। মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। পৃথিবীর অন্য কোনো সেতু তৈরিতে এত গভীরে দিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি। যা পৃথিবীতে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
১০ হাজার টনের বিয়ারিংঃ
দ্বিতীয় রেকর্ড হলো ভূমিকম্পের বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ এর সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত কোনো সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পরের বিশ্বরেকর্ড হলো পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে কোনো সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি।
সব থেকে বড় ক্রেন ব্যবহারঃ
সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রেন ব্যবহার করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। পিলারের ওপর স্প্যান বসাতে যে ক্রেনটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি আনা হয়েছে চীন থেকে। প্রতি মাসে এর ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। সাড়ে তিন বছরে মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বিশ্বে প্রথম কোনো সেতু তৈরিতে এত দীর্ঘদিন ক্রেনটি ভাড়ায় থেকেছে। এই ক্রেনটির বাদাম দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
সেতু নির্মাণে কংক্রিট ও স্টিলের ব্যবহারঃ
পদ্মা সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল উভয়ই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে আর কোনো সেতু নির্মাণে কংক্রিট এবং স্টিল একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। অর্থাৎ সেতুগুলো হয় কংক্রিটে নির্মিত, নাহয় স্টিলের।
সেতু রক্ষায় নদীশাসনঃ
অন্য রেকর্ডটি হলো নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১.৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২.৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদীশাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। পদ্মা সেতু প্রকল্প তিন জেলায় বিস্তৃত। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীরপুরের শিবচর। ভাঙনসহ নানা কারণে পদ্মা সেতু যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্যই নদীশাসন করা হচ্ছে। আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতু বিশ্বে কয়েকটি বিষয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সেটা হলো গভীরতম পাইল হয়েছে পদ্মায়। কারণ পদ্মার মতো এত খরস্রোতা নদী পৃথিবীর বুকে নেই বললেই চলে। আমরা ভূমিকম্প মোকাবিলায় যে বিয়ারিং ব্যবহার করেছি এটা পৃতিবীতে একটা রেকর্ড। এত বড় বিয়ারিং আগে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। এটা প্রায় ১০ হাজার টনের কাছাকাছি। আরও একটা আছে নদীশাসন। সেতুর জন্য ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন আর কোথাও নেই। এত গভীরে আর নদীশাসনও কোথাও হয়নি।
যেসব কারণে বিশ্বরেকর্ড গড়ল পদ্মা সেতুঃ
শনিবার (২৫ জুন) সকাল ১০টায় বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারে টোল নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ১৭ মে সেতু বিভাগের উপসচিব আবুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, মোটরসাইকেলের জন্য টোলের হার ১০০ টাকা; কার, জিপ ৭৫০ টাকা; পিকআপ ভ্যান ১ হাজার ২০০ টাকা; মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা; ছোট বাস (৩১ আসন বা তার কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা; মাঝারি বাস (৩২ আসন বা তার বেশি) ২ হাজার টাকা; বড় বাস (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ছোট ট্রাকের জন্য (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ১০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা; বড় ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা; ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেলের অধিক) ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হবে।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, টোলের এ হার পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলের দিন থেকে কার্যকর হবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। খরস্রোতা পদ্মা নদীর ওপর ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হয়েছে স্বপ্নের এ সেতু। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়।