তিন পার্বত্য জেলার সবচেয়ে পরিষ্কার দূর্গম রুমার মুনলাই পাড়া

185

বান্দরবান প্রতিনিধিঃ-বান্দরবানের দূর্গম রুমা উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট এক পাড়ার নাম মুনলাই। রুমা সদর থেকে বগালেক যাবার পথে দেখা মেলে এ পাড়াটি। বম অধ্যুষিত চোর বিহীন এ পাড়াটির চারপাশে দিনে দুইবার পরিষ্কার করে পরিবারের সদস্যরা। গ্রামবাসীর সকলেই বন সম্প্রদায়ের হলেও তাদের জীবনযাত্রায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। দেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামটিতে চোরের ভয়ে ঘরে তালা দিতে হয় না কখনো।
চোর বিহীন দেশের সবচেয়ে অপরূপ সুন্দর এই গ্রামটির অবস্থান বান্দরবানের রুমা বাজার থেকে বগালেক যাওযার পথে উঁচু-নিচু রাস্তার দুই পাশে। ছোট ছোট ঘর তৈরি করা হয়েছে কাঠের মাচার উপর। প্রতিটি ঘরের সামনে টবে সাজানো রয়েছে নানা রকম ফুলের গাছ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি বাড়ির সামনে রাখা হয়েছে ঝাড়ু ও ডাষ্টবিন, আর ছোট ছোট সাইন বোর্ড ঝুলানো হয়েছে পাড়াটি পরিষ্কার রাখতে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি ও রাস্তা ধারে লাগানো হয়েছে ফুলের গাছ। কোন দর্শনার্থী ও পর্যটক এ পাড়াটি দেখতে আসলে তাদের বিভিন্ন ধরনের বাঁশ নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন তারা। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পাড়া হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে এ পাড়াটি।
স্থানীয়রা জানান, আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে দূর্গম রুমা উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বম সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে এসে আশ্রয় নেয় আর গড়ে তোলে ছোট এক পাড়া। আর এ পাড়াটির নাম রাখা হয় মুনলাই। বর্তমানে ৪৫ পরিবারের বসবাস ও খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারী এ পাড়াটি রুমা সদর থেকে বগালেক যাবার পথে দেখা মেলে। শুরু থেকেই এ পাড়াটি সব সময় তারা পরিষ্কার করে রাখতো।
২০১৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে গোছানো, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম উপাধি দিয়েছেন। তারা বলেন, বর্তমানে এ পাড়াটি দিনে দুইবার পরিষ্কার করে পাড়ার সদস্যরা। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় রাখা হয়েছে ঝাড়ু, ডাষ্টবিন। ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে পাড়া পরিষ্কার রাখার সাইন বোর্ড। বাড়ির সামনে লাগানো হয়েছে ফুলের গাছ। কোন দর্শনার্থী এসে মুগ্ধ হয়ে পাড়াতে বসে বিশ্রাম নিলে তাদের বাড়তি আনন্দ দিতে পাড়ার কিশোর কিশোরীরা পরিবেশন করে বাঁশ নৃত্যসহ নানান আয়োজন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অত্যান্ত পরিপাটি ও সাজানো গোছানো দূর্গম একটি পাড়া মুনলাই। এখানে প্রতিটি বাড়ির সামনে রাখা আছে ডাস্টবিন, দেয়ালে বা গাছের মধ্যে ঝুলানো আছে পাড়া পরিস্কার রাখার নির্দেশনা। এছাড়া প্রতিটি বাড়ির সামনে রয়েছে ফুলের গাছ। বাড়ির আঙ্গিনাসহ রাস্তাঘাট সবই একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এসব কিছুই স্থানীয় ও পর্যটকদের মন কেঁড়ে নেয়।
মুনলাই পাড়ার ৭ম শ্রেনীর বম কিশোরী এলসি লাল থ্লান পার বম বলেন, আমরা সবাই নিজেদের ঘরবাড়ি ও তার চারপাশ সবসময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দর করে রাখি। দিনে ২ বার করে আমরা আমাদের ঘর ও রাস্তাঘাট পরিষ্কার করি।
মুনলাই পাড়ার বম কিশোরী লাল নুন জির বম বলেন, আমরা আমাদের পাড়াকে পরিষ্কার রাখার পর একদিন জানতে পারলাম আমাদের এ পাড়াটি তিন পার্বত্য জেলার শ্রেষ্ঠ পাড়া নির্বাচিত হয়েছে, এতে পাড়ার সবাই অত্যান্ত আনন্দিত।
মুনলাই পাড়া কমিটির সভাপতি ডেবিট বম বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাড়া হিসেবে পরিচিত লাভ হওয়ার পর বর্তমানে আমরা আমাদের পাড়াকে কিভাবে আরও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায় তার জন্য সবসময় কাজ করছি। শুধু পরিষ্কারই নয়, আমরা আমাদের ঘরের আঙ্গিনায় ও রাস্তার পাশে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে ফুলের গাছ লাগিয়েছি। এতে আমাদের চারপাশ পরিস্কারের পাশাপাশি সুন্দরও হয়েছে এবং নিজেদেরও ভালো লাগছে।
মুনলাই কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের সভাপতি রিয়্যালবো বম বলেন, অবস্থা যেমনই হোক, পাড়া সবসময় পরিষ্কার রাখাই ছিল আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্যে। আমাদের নির্দেশনা সবসময় নিজের বাড়ি ও তার আশপাশ নিজেদের দায়িত্বে পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য প্রতিটি বাড়ির সামনে ডাস্টবিন ও দেয়ালে বাড়ি পরিস্কার রাখতে নির্দেশনা দেয়া আছে। আমাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ২০১৯ সালে এ পাড়াটিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে গোছানো, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গ্রাম উপাধি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
রুমার রেমাক্রী প্রাংসার ইউপি চেয়ারম্যান জিরা বম বলেন, এ পাড়াটিকে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যেন বাইরে থেকে যারা বেড়াতে আসে তারা দেখে সন্তুষ্ট হয়। শুধু পরিষ্কারই নয়, কেউ বেড়াতে আসলে এখানকার তরুন তরুনীরা নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে তাদেরকে বাড়তি আনন্দের যোগান দেয়। এতে করে তারা অনেক আনন্দ করেন এবং খুশি হন।
রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলী বলেন, মুনলাই পাড়া ৪৫টি পরিবারের একটি পাড়া। এখানে সবাই বম কমিউনিটি পরিবারের সদস্য এবং খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারী। বিভিন্ন প্রয়োজনে তারা বিদেশে গিয়ে দেখেছে যে, সে দেশ অনেক সুন্দর এবং সেখান থেকেই তারা শিখেছে কিভাবে নিজ পাড়াকে সুন্দর ও গোছানো রাখা যায়। আমরাও প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেখানে ডাস্টবিন প্রয়োজন সেখানে তা দিয়েছি। এছাড়া তাদের কোন দাবি থাকলেও তা প্রশাসন পূরণ করছে এবং পাড়াটি পরিষ্কার রাখতে যতটুকু সহযোগিতা লাগবে তার সবটুকুই প্রশাসন করবে এবং করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।