মাতামুহুরী ও সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে হেলিকপ্টার থেকে ছিটানো হলো বিরল ও বিলুপ্ত ৩০ প্রজাতির বীজ

114

হাসান মাহমুদ, রাহুল বড়ুয়া ছোটন, আলীকদমঃ-লামা ও বান্দরবান বন বিভাগের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ও বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের সাহায্যে আকাশ হতে সীডবল নিক্ষেপের মাধ্যমে মাতামুহুরী ও সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে প্রায় ৩০ প্রজাতির বনজ বীজ ছিটানো হয়েছে। চাম্পাফুল, পুতিজাম, ঢাকিজাম, কালোজাম, গামার, করই, জারুল, হারগাজাসহ ইত্যাদি প্রজাতির বীজ বপন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের বান্দরবান রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জিয়াউল হক, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি এ কার্যক্রমের উদ্বোধনের পর মাতামূহুরী সংরক্ষিত বনে এ বীজ সীড বলের মাধ্যমে ছিটানো হয়।
এসময় তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য জীব-বৈচিত্র দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্রের অনেক প্রজাতি ইতিমধ্যে আমাদের পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী বিরল তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে বৃক্ষ ও বনাঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস, জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি দেশের উন্নয়নের মূলধারা অব্যাহত রাখতে হলে ব্যাপকহারে বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরী। একই সাথে জনসাধারণকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করা এবং বনাঞ্চল সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করা একান্ত অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযােগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি আত্মনির্ভরশীল, উন্নত ও টেকসই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশে টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের অংশ হিসেবে সবুজায়ন ও বনায়ন কর্মসূচীর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা বাস্তাবায়ন করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলি আমাদের দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবেলা, পরিবেশ রক্ষা ও একটি অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই ধরনের বনায়ন কর্মসূচীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আকাশ হতে সীডবল নিক্ষেপের মাধ্যমে বনায়ন এই প্রথম বলে জানান চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোঃ আব্দুল আওয়াল সরকার। তবে এ পদ্ধতিতে বীজ বপন বাংলাদেশে এটি দ্বিতীয়। এ সময় তিনি বলেন, বিট্রিশ আমলের পর এই প্রথম রির্জাভ বন এলাকা রক্ষায় এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাতামূহুরী সংরক্ষিত বনের আয়তন ১লাখ ২হাজার একর ও সাঙ্গু সংরক্ষিত বনের আয়তন ৮৩ হাজার দুইশত একর। এ রিজার্ভ বনের যেসব এলাকায় গাছের সংখ্যা কম এসব এলাকাতেই হেলিকপ্টার থেকে বীজ ছিটানো হয়েছে।
এদিকে লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম কায়চার বলেন, মাতামূহুরী ও সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে বনায়ন কর্মসূচীতে ৩০ প্রজাতির ৪৮০ কেজি বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির বীজ ছিটানো হয়েছে। যা জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ কার্যক্রম সরকারি পর্যায়ে নয় শুধু মাত্র লামা ও বান্দরবান বন বিভাগের উদ্যোগে এ বীজ ছিটানো হয়েছে। তিনি এ সময় বলেন, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ৮০শতাংশ বীজের অঙ্কুরোদগম হবে। এতে বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সহায়ক হবে।
এসময় এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোঃ আব্দুল আউয়াল সরকার, বর্ডার গার্ড আলীকদম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মোঃ ইফতেখার হোসেন পিএসসি, আলীকদম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম, ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ কফিল উদ্দিন, লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস এম কাইছার, বান্দরবান বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: ফরিদ মিয়া, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মংব্রাচিং মার্মা, সাধারণ সম্পাদক ধুংড়ি মার্মাসহ সেনাবাহিনী, বন বিভাগ ও সরকারী বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্তার উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আলীকদম উপজেলার আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে লামা বন বিভাগ ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটিবি)র বনায়ন প্রকল্পের আওতায় বিস্তীর্ণ রির্জাভ এলাকায় ফলজ, বনজ ও সৌন্দর্য্য বর্ধনকারী বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপন শুরু করা হয়েছে। বিএটিবি’র বনায়ন প্রকল্পের আওতায় সড়ক সৌন্দর্য্য বর্ধনে লামা বন বিভাগকে ৫৫ হাজার চারা দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে এ দুটি রিজার্ভ পরেষ্টে ব্যাপক হারে জুমচাষ হওয়ায় জুম চাষীরা হাজার হাজার একর জমি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এতে করে প্রায় বিভিন্ন এলাকা ন্যাড়া পাহাড়ে পরিনত হচ্ছে। অপরদিকে কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ব বেড়ে যাওয়া মাতৃবৃক্ষ শুন্য হয়ে পড়েছে বনাঞ্চল। ফলে বৃক্ষের প্রাকৃতিক পরাগায়ন ও প্রাকৃতিক বনায়ন নেমে এসেছে শুন্যের কোটায়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য ব্যতিক্রমি এই উদ্যোগ গ্রহন করেছে লামা বন বিভাগ।
৭৪ হাজার হেক্টরের ভার্জিন ফরেষ্ট খ্যাত সাঙ্গু ও মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেশের সর্বদক্ষিনের জেলা বান্দরবানের থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অবস্থিত। এটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্রের হটস্পট হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বৃক্ষ নিধনের ফলে এখানকার বন্য প্রাণীদের অধিকাংশ বিলুপ্ত প্রায়। এসব বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পেছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরো একটি হল, পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের খাদ্য তালিকায় রয়েছে এদের অনেকেই। এছাড়াও পাথর উত্তোলন, বাঁশ ও গাছ কর্তন করার ফলে পানির উৎস্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এদের অনেকেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেষ্টের কালাইয়ারছড়া এলাকায় একটি বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ঘোষনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।