ভালো নেই লামার ৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৯৬টি পরিবারের মানুষ

177

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,লামাঃ-ছাউনির টিনে মরিচা ধরে বিভিন্ন স্থানে ছিদ্র হয়ে গেছে। বৃষ্টি এলে টিনের ফুটো দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে ঘরের ভেতর। ভিজে যায় চাল, ডালসহ অন্য খাদ্য ও আসবাবপত্র। বৃষ্টি হলে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। ঘরের জিনিসপত্র রক্ষায় চালের ফুটো বরাবর হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন বাসন পেতে পানি আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলে। পানি আটকাতে অনেকে আবার ঘরের ভেতর টাঙিয়ে দিয়েছেন পলিথিন।
এ চিত্রটি বান্দরবানের লামা উপজেলার সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা, রুপসীপাড়া ইউনিয়নের শিলেরতুয়া ও গজালিয়া ইউনিয়নের বাইশপাড়ি আশ্রয়ণ পল্লীর। তিনটি ইউনিয়নে খাস ও ক্রয়কৃত পাহাড়ি জায়গায় সরকারি অর্থায়নে অসহায় দরিদ্র মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টি হলেই ঘর ও ঘরের বাইরে কাদায় একাকার হয়ে যায়। এতে করে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারেন না। স্যানিটেশনেরও বেহাল অবস্থা। যা কয়েকটি টয়লেট আছে তা ভেঙ্গেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে থেকে অনবরত ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। অনেকের পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় খোলা জায়গার সেরে নিচ্ছে মল ত্যাগের কাজ। এর মধ্যেই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছে ৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৯৬টি পরিবারের প্রায় দেড় হাজার মানুষ।
জানা গেছে, আবাসন ও আত্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’-এর আওতায় লামা সদর ইউনিয়নে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে মেরাখোলা এলাকায় ২৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে অসহায় হতদরিদ্র ১৩০টি পরিবারের মানুষের জন্য ১৩টি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়। এটি লামার প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্প। পরবর্তীতে ২০১১-১২ অর্থবছরে উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের বাইশপাড়িতে ৫ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে ৫০টি পরিবারের জন্য ৫টি ব্যারাক ও রুপসীপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব শিলেরতুয়া এলাকায় ৬০ শতক জায়গা ক্রয় করে ৪০টি পরিবারের জন্য ৪টি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে মেরাখোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৩০ পরিবার, পূর্ব শিলেরতুয়ায় ৪০ ও গজালিয়া বাইশপাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৬টি পরিবার রয়েছে। ৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাঙ্গালী, হিন্দু ও মার্মা সম্প্রদায়ের মোট ১৯৬ পরিবার বসবাস করছে। ব্যারাকে পাঁচ পরিবারের জন্য একটি করে টয়লেট এবং ১০ পরিবারের জন্য একটি নলকূপ নির্মাণ করা হয়। টয়লেট ও নলকূপ গুলো এখন নষ্ট ও ব্যবহারের অনুপযোগী। কাজটি সমাপ্ত হলে তিনটি ইউনিয়নের ২২০টি পরিবারকে তুলে দেওয়া হয় এই আশ্রয়ণ পল্লীতে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কাজটি বাস্তবায়ন করে। জরাজীর্ণ ও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে কিছু পরিবার নিরুপায় হয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প ছেড়ে চলে গেছে।
মেরাখোলা পল্লীর বাসিন্দা চেমন খাতুন (৫৫) ফজলুল করিম (৪৩), পারভীন আক্তার (৩০) ও হালিমা খাতুন (৬০) জানান, ব্যারাক গুলো নির্মাণের সময় লোহার ফ্রেমের ওপর টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ২৪ বছর মেরামত না হওয়ায় টিনের ছাউনি ও চারপাশের বেড়ার টিন নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া লোহার অ্যাংগেলের গুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। মরিচা ধরা টিন ফুটো হয়ে এসব স্থান দিয়ে ঘরের ভেতর পানি পড়তে থাকে। আমরা কোনমতে পলিথিন দিয়ে আছি। বৃষ্টি এলে রাতে ঘরে থাকা যায় না। শিশু ও বৃদ্ধা নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করতে হয়।
একই পল্লীর বাসিন্দা কাউছার বেগম (২১), মনতাহারু বেগম (৭০) বলেন, কোনো কারণে বৃষ্টির সময় বাড়িতে না থাকলে চাল, ডাল, বিছানাসহ ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র ভিজে যায়। বর্ষায় তাদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। বর্তমানে পল্লীর প্রতিটি ঘরের ভেতর পলিথিন টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি চলে গেলে পলিথিনে আটকে থাকা পানি সরিয়ে নেওয়া হয়। বাকী দুইটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের একই অবস্থা।
মেরাখোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের সর্দ্দার সেকান্দর আলী জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের কোন আয়বর্ধক কাজকর্ম নেই। সবাই দিনমজুরি, কৃষিকাজ, ভ্যান-আটো চালিয়ে ও গাছ-বাঁশ কেটে সংসার পরিচালনা করেন। অনেকের ঘরে আয় করার মত লোক না থাকায় বয়স্ক, বিধবা ভাতা ও সরকারি ত্রাণ তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। এ অবস্থায় ঘর মেরামত করার মতো অর্থ তাদের হাতে নেই। ৩টি পল্লীর লোকজন সবারই অবস্থাও একই রকম।
এদিকে পার্বত্য এলাকা হওয়ায় ও বন্দোবস্তী বন্ধ থাকায় ৩টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের জায়গা পল্লী ও পল্লীর বাসিন্দাদের নামে নামজারি হয়নি। মেরাখোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জিয়াবুল হক, মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, আমাদের পল্লীর জন্য ২৫ এর জায়গা অধিগ্রহণ করে সরকার। বর্তমানে ৫ একর জায়গাও নেই। বাকীটা আশপাশের লোকজন তাদের বলে দখল করে নিয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করায় আমাদের নামে মামলা দিয়ে হয়রাণী করছে। তারা ভূমির সমস্যার সমাধানে জেলা প্রশাসক বান্দরবানের সহায়তা কামনা করেন।
এবিষয়ে সদর ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন বলেন, নির্মাণের পর থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যারাক গুলো সংষ্কার না করায় জরাজীর্ণ ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা বিষয়টি লামা উপজেলা ও বান্দরবান জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছি। রুপসীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা বলেন, সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধায় আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষকে অগ্রাধিকার দেই। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল। পল্লীর জায়গা তাদের নামে নামজারি না হওয়ায় তারা সরকারি বিভিন্ন সুবিধা ও ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গজালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান বাথোয়াইচিং মার্মা উপরে উল্লেখিত সমস্যা গুলোর সাথে একমত জানিয়ে বলেন, পল্লীর যাতায়াতের রাস্তা ও তাদের আয়বর্ধক মূলক কাজের ব্যবস্থা করা জরুরী।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীর তিবরীজি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানদের সমন্বয়ে দ্রুত আশ্রয়ণ প্রকল্প গুলো সংষ্কার ও মেরামতে উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপশি পল্লীর বাসিন্দাদের সরকারি সহায়তা দেয়ার জন্য চাহিদাপত্র চাওয়া হবে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভূমি সমস্যা সমাধানে এখন সম্ভব না হলেও অচিরে সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিব।