নানিয়ারচর চেঙ্গী নদীর খাল খননঃ জলে ভেসে যাচ্ছে সরকারের কোটি টাকা

98

নানিয়ারচর প্রতিনিধিঃ-সরকার কর্তৃক ঘোষিত ডেল্টা প্লানের প্রকল্প “৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প এর আওতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের অগোচরে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি নানিয়ারচর উপজেলায় অবস্থিত তিন কিলোমিটার লম্বা এই চেঙ্গী খাল খননের প্রকল্প হাতে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক কন্সট্রাকশন।
নানিয়ারচরের চেঙ্গী নদীর খাল খননের প্রকল্পে খননকৃত মাটি খালের পাশে স্তুপ করে রাখায় মৌসুমের প্রথম বর্ষনেই পুনরায় তা পানিতে মিশে যাচ্ছে। আর খালটি পুনঃখনন শেষ হওয়ার আগেই ঘনবর্ষা ও পাহাড়ি ঢলে প্রকল্পটির কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম না দেওয়ায় কাজ অসমাপ্ত হয়ে আছে। তবে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনসাধারণের মতামতের তোয়াক্কা না করে চেঙ্গী নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে এই প্রকল্পের সরকারের কোটি টাকা।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক কন্সট্রাকশন সূত্রে জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে টেন্ডার হলেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবং চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে এই খালটি পুনঃখনন সম্ভব হয়নি এবং চলতি বছরের ১৮ই এপ্রিল থেকে ২টি লং-বুম এক্সকেভেটর দিয়ে সদ্য নির্মাণকৃত নানিয়াচর উপজেলার ব্রিজের নিচে চেঙ্গি নদীর বামফিলিং এলাকার নিকটস্থ এই খালটি পুনঃখনন এর কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামার আগে ৩ কিলোমিটার লম্বা এই খালটি খনন সম্পন্ন করতে করতে পারেননি।
এছাড়া কাজের গুনগত মান নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীদের মাঝে। কোনো প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়া যেখানে বছরের ৯ মাস ৪০ ফুট পানির নীচে থাকা ডুবন্ত খালকে খনন করার নামে খাম খেয়ালিপনা প্রকল্প ছাড়া আর কিছু নয় বলে প্রকল্পটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। আর খাল খননকৃত মাটি দুরে পাহাড়ের পাশে না ফেলে পাশেই রাখা হচ্ছিল। যা পরবর্তীকালে চেঙ্গি নদীর পানি ভরাট হলে কোন কাজে আসবে না। সরকারের বরাদ্দকৃত টাকাগুলো পানিতে যাচ্ছে। যে খাল খনন বর্তমানে প্রয়োজন নেই বলে সাফ জানিয়েছেন স্থানী এলাকাবাসীরা।
বিষয়টি নিয়ে নানিয়ারচর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নুরজামাল হাওলাদার বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে খালটি খনন করার ফলে বৃষ্টির পানিতে আবারো খালটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খনন কাজে প্রকৌশলীরা যে টাকার হিসাব করেছে তা সরাসরি সরজমিনে এসে সেই হিসাবে খনন কাজ করেছে কিনা তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে দেখা দরকার।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হক কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী আলী বাবর জানান, খালে পাহাড়ি ঢল নেমে যাওয়ায়, খাল খননে জলাবদ্ধ পানি মূল খালে নেমে যাওয়াসহ বেশকিছু কারনে আমরা গত মাসেই কাজ বন্ধ করে দেই। যতটুকু কাজ হয়েছে সেই কাজের বিলটাও আমরা আজো পায়নি।
রাঙ্গামাটি কাপ্তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আলম বলেন, এলাকার স্থানীয় মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার্থে এই খাল খনন কর্মসূচী প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। যাতে করে মানুষ তিনটি মাস তাদের যাতায়াতের দূর্ভোগ থেকে রক্ষা পায়। তিনি আরো বলেন, ৩ কিলোমিটার খাল খননের ১.৩কিলো খনন হয়েছে। বাকিগুলো আগামীতে নতুন বাজেট সংযুক্ত করে করা হবে। একই সাথে পানিতে মিশে যাওয়া মাটি পুনরায় খনন করা হবে। খননকৃত মাটি স্তুপ কোথায় রাখা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পে মাটি দূরে ফেলার আইটেম ছিল না। তাই তা ঠিকাদারদের দিয়ে কাজটি সম্পন্ন হয়নি। তবে আমরা চেষ্টা করব পুনরায় খননে মাটি দূরে ফেলার আইটেম যুক্ত যাতে করা হয়।
এই বিষয়ে নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা জানিয়েছেন, চেঙ্গী খাল খননের কাজের গুনগত মান খুবই খারাপ হয়েছে। উপজেলা পরিষদকে না জানিয়ে প্রকল্পের কাজ হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এত বড় প্রকল্পটিকে খামখেয়ালি ভাবে করা হয়েছে যা সত্যিই লজ্জাজনক। এছাড়া উপজেলা পরিষদকে না জানিয়ে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত। বর্তমানে আষাঢ়ের বৃষ্টিতে চেঙ্গি খাল পানিতে ভরপুর হয়ে গেছে। প্রকল্পের কাজ অর্ধেকও হয়নি সুতরাং আমার পক্ষ থেকে বলতে চাই, যেহেতু প্রকল্পটি জনগনের কোন কাজে আসছে না। সেহেতু সরকারের কাজটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
এই বিষয়ে নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিউলী রহমান তিন্নি জানিয়েছেন, নানিয়ারচরের চেঙ্গী নদীর খাল খননের প্রকল্পে কাজ করা হয়েছিলো। কিন্তু প্রকল্প বন্ধ করার বিষয়ে আমি অবগত নই। উপজেলা প্রশাসন এই ব্যাপারে জানেন না।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডেল্টা প্লান প্রকল্পের সভাপতি ও রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমানের কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে, নানিয়ারচরে সদ্য নির্মাণকৃত ২৫০ মিটারের বিশাল ব্রিজ ও সড়কের উন্নয়ন কাজের কারনে আবারো সরকারি অর্থ গচ্ছা দিয়ে এই খাল খনন বর্তমানে কোন প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
উল্লেখ্য, নানিয়ারচর ব্রীজের নিচে চেঙ্গি খালটি থেকে সরু ড্রেনের মতো করে পানি চলাচলের দুইপাশ থেকে মাটি তুলে পাশেই স্তুপ করে রাখা হয়েছিলো। আর যেখানে মাটি স্তুপ করা হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে তা ৩০ ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায়। এসময় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করা হলে সাফ জানিয়ে দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বাজেট সল্পতার কারনে দূরে মাটি রাখা হচ্ছে না।