এবারোও বৈসাবীতে করোনার থাবাঃ কাপ্তাইয়ে ঘরোয়া ভাবে পালিত হবে নববর্ষের আয়োজন

257

ঝুলন দত্ত, কাপ্তাইঃ-পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ী সম্প্রদায়ের অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বৈসাবী। চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু, মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাঁই, তনচংগ্যা সম্প্রদায়ের বিষু, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এই উৎসব বৈসু নামে পরিচিত হলেও সকলে বর্ষ বিদায় এবং নববর্ষকে বরন উপলক্ষে এই উৎসব গুলো পালন করে থাকেন। কিন্ত করোনা ভাইরাস এর কারনে এবারও কাপ্তাইয়ে হচ্ছে না প্রাণের বৈসাবী উৎসব। প্রতিবছর এপ্রিল প্রথম সপ্তাহ থেকে পাহাড়ের এই উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত থাকতো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। কি শহর কি গ্রাম প্রতিটি এলাকায় হতো বর্নিল এই উৎসব এর আয়োজন। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, র‌্যালি, পাজন ও পিঠা পায়েস রান্না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ নানা আয়োজনে মুখরিত থাকতো পাহাড়ের প্রতিটি জনপদ। মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে গতবছর এর মতো এবারও বড়সড় উৎসব বাদ দিয়ে একান্ত ঘরোয়াভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে এই উৎসব পালন করবেন এখানকার বসবাসরত পাহাড়ী জনগণ।
কাপ্তাই উপজেলায় বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ট হলো মারমা ও তনচংগ্যা সম্প্রদায়।
কাপ্তাই এর চিৎমরম, ওয়াগ্গা, রাইখালী এবং কাপ্তাই ইউনিয়ন এর হরিনছড়ায় মারমা সম্প্রদায়ের বসবাস। এই উপজেলার চিৎমরমে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহার চিৎমরম খিয়াং। প্রতিবছর এখানকার মারমা জনগোষ্ঠী ১৫ এপ্রিল পালন করে থাকে সাংগ্রাঁই জল উৎসব যা জলকেলী উৎসব নামে পরিচিত। বিগত কয়েক দশক ধরে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ১৪ এপ্রিল হতে ১৬ এপ্রিল চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার মাঠে বসতো বৈশাখী মেলা, হতো ঐতিহ্যবাহী মারমা সম্প্রদায়ের নাচ, গান, খেলাধুলা। উৎসবকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসতো এবং উপভোগ করতো এই আয়োজন। এমনকি বিদেশী অনেক পর্যটকও এই উৎসবে যোগ দিতো, কিন্ত করোনার মহা থাবায় গত বছরের মতো আয়োজক কমিটি এই বছরেও সমস্ত উৎসবের আয়োজন বাতিল করেছেন।
চিৎমরম সাংগ্রাঁই জল উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক ক্যাপ্রু চৌধুরী সদস্য সচিব পাই সিং মং মারমা জানান, আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিলো, কিন্ত করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক জনসমাগম এড়াতে আমরা এই বছর আমাদের উৎসব বড়পরিসরে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তবে খিয়াং এ আমরা স্বাস্থ্য বিধী মেনে ছোট পরিসরে পুজা দিবো এবং পরিবার পরিজন নিয়ে ঘরে বসে এই উৎসব পালন করবো।
মারমা সংস্কৃতি সংস্থা ( মাসস) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক চিৎমরম এর বাসিন্দা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মংসুইপ্রু মারমা, চিৎমরম এর বাসিন্দা মাসাথুই মারমা, নাইম্রাচিং মারমা এই প্রতিবেদককে জানান, সাংগ্রাঁই তাদের প্রাণের উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে কতো প্রস্তুতি থাকতো তাদের, কিন্তু করোনার কারনে তারা এই বছরেও এই আনন্দযজ্ঞ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অপরদিকে কাপ্তাইয়ে বসবাসরত তনচংগ্যা সম্প্রদায় তাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব বিষুকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজনে মুখরিত রাখতো তাদের প্রতিটি পল্লী। এই উৎসবকে ঘিরে ওয়াগ্গা ইউনিয়ন এর বিভিন্ন পাড়াতে অনুষ্ঠিত হতো ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে বিষু র‌্যালি, গ্রামীণ খেলাধুলা, পাজন রান্না, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ নানা আয়োজন। এই সম্প্রদায়ের ১২ এপ্রিল ফুল বিষু, এদিন নদী বা ছড়াতে ফুল ভাসানো হতো , ১৩ এপ্রিল মূল বিষু, এবং ১৪ এপ্রিল বুধবার নববর্ষ। এদিন তারা সকালে মন্দিরে গিয়ে সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করে, এইছাড়া সকলে এদিন পাজন, বিভিন্ন ধরনের পিঠা এবং যার যার সামথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন উপাদেয় খাবার রান্না করে এবং একে অপরকে আপ্যায়ন করাতো। কিন্ত এইবারেও করোনার কারনে তাদের সমস্ত কর্মসূচী বাতিল করা হয়েছে বলে জানান, ওয়াগ্গা মৌজার হেডম্যান অরুণ কুমার তালুকদার। তিনি জানান, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা এই বছর জনসমাগম হয়, এমন অনুষ্ঠান হতে বিরত থাকবো, তবে পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা ঘরে বসে এই উৎসব পালন করবো।
ওয়াগ্গা ইউনিয়ন এর বাসিন্দা তনচংগ্যা গানের শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার সুর্য্যসেন তনচংগ্যা জানান, প্রতিবছর বিষু এলে নতুন নতুন গান রচনা করতাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এইসব গান পরিবেশিত হতো। কিন্তু করোনার কারনে আমরা এইবারও এই উৎসব করতে পারছিনা বড় পরিসরে।
ওয়াগ্গা ইউনিয়ন এর বাসিন্দা জনপ্রিয় বেতার ও টিভি শিল্পী জ্যাকলিন তনচংগ্যা জানান, প্রতিবছর বৈসাবিতে বিভিন্ন খেলা, সংগীতানুষ্ঠান হয়। কিন্তু গতবছর কোনো অনুষ্ঠান হয়নি এবং এই বছরেও হবেও না। এই নিয়ে ছোটো এবং বড়দের মধ্যে দুঃখের শেষ নেয়।
শুধুমাত্র পাহাড়ী জনগোষ্ঠী নয, নববর্ষকে কেন্দ্র করে কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসন, বানৌজা শহীদ মোয়াজ্জেম ঘাঁটি, বিজিবি, সেনাবাহিনী, কেপিএম, কাপ্তাই উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি, চন্দ্রঘোনা চম্পা কুঁড়ি খেলাঘর আসরসহ নানা সামাজিক সংগঠন নানা আয়োজন করে থাকতো, কিন্ত করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই বছরেও সমস্ত আয়োজন বাতিল করেছেন স্ব-স্ব কর্তৃপক্ষ।
“আবার জমবে মেলা, হাট খোলা বটতলা” আবার আসবে দিন সুদিন, যেইদিন করোনা মুক্ত হবে এই ধরনী, সকলের এই প্রত্যাশা।