নিজস্ব প্রতিবেদক: চীবর উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে রাঙামাটি রাজবন বিহারে শেষ হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব পয়তাল্লিশ তম কঠিন চীবর দান উৎসব।
আজ শুক্রবার দুপুরে গৌতম বুদ্ধ ও বনভান্তের প্রতিকৃতিতে চীবর দান ও ধর্মীয় দেশনার মাধ্যমে সাঙ্গ হয় এবারের দানোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। গত বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটায় বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দু’ব্যাপী এই উৎসবের। তার আগে মাসব্যাপী রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বিভিন্ন বিহারে মাসব্যাপী এ কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠিত হয়। রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারের চীবর দান উৎসবই পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব
এছড়াও আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও পাহাড়ের সর্ববৃহৎ চীবরদান উৎসবকে ঘিরে লক্ষাধিক দায়ক-দায়িকা, পূর্ণার্থীর সমাগত ঘটেছে পুরো বিহার এলাকাজুড়ে।
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান গৌতম বুদ্ধের জীবব্দশায় মহাপূর্নবতী বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত ২৪ ঘন্টার মধ্যে সূতা কাটা শুরু করে কাপড় বয়ন, সেলাই ও রং করাসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করা হয়ে থাকে বলে একে কঠিন চীবর দান হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক-বাচনিক এবং মানসিক পরিশ্রম অধিকতর ফলদায়ক হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। তাই বিশাখা প্রবর্তিত এ ঐতিহাসিক নিয়ম অনুসারে মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে পাহাড়ী নারীরা চরকায় তূলা থেকে সূতা বের করে বেইনের (কোমড় তাঁত) মাধ্যমে সেই সূতা দিয়ে কাপড় বুনন ও রং করে চীবর প্রস্তুত করে তা দান করা হয়। এজন্য এ দানকে কঠিন চীবর দান হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২৪ ঘন্টায় তৈরি করা চীবরটি সমবেত পূণ্যার্থীদের পক্ষে মহাপরিনির্বাণ লাভী মহাসাধক শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভান্তের উত্তরসূরি ও রাজবন বিহারের আবাসিক ভিক্ষুপ্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবিরকে হস্তান্তর করে উৎসর্গ করেন চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়।
এ সময় রাঙামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার, চাকমা রাণী য়েন য়েন রায়, রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষ কেতু চাকমা, রাঙামাটি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়াদ মেহমুদ, জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ, পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির, রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, রাঙামাটি সদর জোনের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদায়ান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুস্মিতা খীসা।
অনুষ্ঠানে রাজবন বিহারের আবাসিক ভিক্ষুপ্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির পূণ্যার্থীদের মাঝে ধর্মীয় দেশনা দেন। এ সময় শ্রীমৎ জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবির, শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত মহাস্থবিরসহ শতাধিক বৌদ্ধভিক্ষু মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রতি বছর মহামতি গৌতম বুদ্ধের প্রধান সেবিকা মহাপুণ্যবতী বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে রাজবন বিহারে আয়োজন করা হয় কঠিন চীবর দানোৎসব। প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও আগের ঐতিহ্যবাহী এই নিয়মে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে চরকায় সুতা কেটে বুনন ও তৈরি শেষে চীবরটি (বৌদ্ধভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) দান করা হয় বৌদ্ধভিক্ষুদের সমীপে।
এবারের বেইন ঘরের ২০০টিকোমড় তাঁতের চরকা চরকীতে ২৫০শ জন পাহাড়ী ধর্ম প্রাণ নারী ২৪ ঘন্টার মধ্যে চরকায় তূলা থেকে সূতা বের করে কাপড় বুনন, রংকরণ ও সেলাই করে চীবর (কাপড়) প্রস্তুত করেন। আজ বিকালে এসব চীবর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে দান করা হয়
রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারসহ তিন পার্বত্য জেলার রাজবন বিহারের শাখাসমূহে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পাদন করা হয়ে থাকে।