অতো গভীরভাবে সাত-পাঁচ ভেবে সাংবাদিকতায় আসিনি। যে বছর পত্রিকার পাতায় কলম ধরতে শিখেছি সে বছরই বগুড়া শহর থেকে খবর পাই যশোরের সাংবাদিক শামসুর রহমানকে মেরে ফেলা হয়েছে। দু’বছর আগে হারাতে হয়েছে রানার পত্রিকার সম্পাদক মুকুলকে।
কয়েক বছরের মাথায় হারালাম হুমায়ন কবির বালু, বগুড়ার দীপংকর চক্রবর্তী, ফরিদপুরের গৌতম দাসকে। ঢাকায় যোগ দেওয়ার পর কয়েক বছরের মাথায় ২০১২ সালে খুন হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। প্রবীণ সাংবাদিক ফরহাদ হোসেন খুন হলেন নিজ ঘরে।
এতোসব হত্যাকাণ্ড কি ভেতরকে নাড়া দিয়েছে কখনো? এই যে আপনারা সারাক্ষণ সাংবাদিকদের নিরাপত্তা-নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন, এসব নিয়ে আমি কি কখনো ভেবেছি? হ্যাঁ, ভেবেছি। ফরিদপুরের গৌতম দাস খুন হওয়ার পর বগুড়া ‘সংবাদ’ অফিসে যখন একা একা রাতে ঘুমাতাম, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ঘুমাতেও পারিনি অনেকদিন।
দীপংকর চক্রবর্তীর শরীর থেকে আলাদা হওয়া মাথা দেখে কুঁকড়ে উঠেছি। ভেবেছি এমনভাবে মানুষ মানুষকে খুন করতে পারে?
সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর সেই খুনের ভয়াবহতা দেখে অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে। আমিও তখন আপনাদের মতো নিরাপত্তা নিয়ে ভেবেছি। তবে সেই ভাবনার যোগফল কিন্তু শূন্য হয়েছে। নিরাপত্তা নামক কোনো শব্দ ধরা দেয়নি সাংবাদিকতার দেড়যুগের এই ক্যারিয়ারে।
সশেষ গত মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) রাতে পাবনায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে সাংবাদিক সুবর্ণা নদীকে। এই সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের আর্থিক নিরাপত্তাসহ একজন নারীকে বাস করতে হলে কতোটা সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় সেটা সুবর্ণা নদীর জীবন সংগ্রাম বিশ্লেষণ করলেই হয়তো বেরিয়ে আসবে।
বলার প্রসঙ্গ সেটা নয়। আমি বলতে চাই লাশের মিছিল তো অনেক লম্বা হলো, কিন্তু কই সে বিচার, সাংবাদিকদের কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা? কোনো কিছুই কি নিশ্চিত করা গেছে? আগে যেসব খুন হওয়া বরেণ্য সাংবাদিকদের নাম এনেছি তাদের একটি হত্যাকাণ্ডেরও কি বিচার হয়েছে? উত্তর আপনারা জানেন!
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, অতো সাত-পাঁচ ভেবে সাংবাদিকতায় আসিনি। তবে ভেবেছিলাম সমাজের অন্যায়-অনিয়ম-অবিচার-বৈষম্য ইত্যাদি যতো ধরনের শব্দ আছে সবগুলোকে লেখনির মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবো। আর একটু স্বচ্ছলভাবে বেঁচে থাকবো। জানতাম, আর ৮-১০টা চাকরির মতো নয় সাংবাদিকতা। তাই তো প্রথম মাসে কাজ করার পর বগুড়ার অন্যতম দৈনিক উত্তরবার্তার সম্পাদক মাহববুল আলম টোকন ভাই হাতে গুজে গিয়েছিলেন ৩০০ টাকা। ঢাকায় মানবজমিন পত্রিকায় শিক্ষানবীশ রিপোর্টার হিসেবে পেয়েছি ৪ হাজার টাকা।
তারপর গত বারো বছরে কত চড়াই-উতরাই, বেতন পাওয়া, না পাওয়া, বোনাস পাওয়া না পাওয়া, চাকরি থাকা না থাকা নিয়ে চলতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গটা আনছি এ কারণে, সাংবাদিকদের কাজ করার ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি যেমন রয়েছে তেমনি আর্থিক ঝুঁকিও কি আমাদের পিছু ছাড়ে কখনো? ছাড়ে না।
শুধু মফস্বল বলি কেন, ঢাকার অনেক পত্রিকাই নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে না। এসব পত্রিকার সাংবাদিকদের যে কী দুর্বিসহ জীবন, আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা- কেউ কি খোঁজ নেয়? জীবন নির্বাহের ব্যয় মেটাতে গিয়ে এসব সাংবাদিক দিনের পর দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কেউ মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছেন। মালিকপক্ষের এই আচরণ কি খুনের চেয়ে কম? এতো এতো আয়োজনের পত্রিকার বের হয়, খোঁজ নিয়ে দেখুন তো কয়টি পত্রিকা সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করেছে?
অথচ প্রভাব খাটিয়ে এরা ঠিকই সরকারি বিজ্ঞাপন আদায় করছে। নিজেরা আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আর আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিমুহূর্তে চাকরি যাওয়ার ভয় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে একেকজন সাংবাদিককে। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন কি কোনোকালেই সম্ভব নয়?
পাবনার নারী সাংবাদিক নদী খুন হওয়ার পর নতুন করে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে। সারাদেশের সাংবাদিকরা রাস্তায় নেমেছে। যেমনটি ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের জন্য ঢাকায় সাংবাদিকরা সমাবেশ করে, মানববন্ধন করে। অদৃশ্য কারণে কয়েকদিন পরে থেমে যায় সেই আন্দোলন। আবার কোনো ঘটনা ঘটলে রাস্তায় নামবেন সাংবাদিকরা। এভাবেই চলছে। চলবে হয়তো।
আমাদের সামনে সাংবাদিকদের কিছু পাওয়ার কোনো পোক্ত উদাহরণ আছে কী? নেই। প্রতিবছর কিছু সাংবাদিকের ‘দুঃস্থ সাংবাদিক’ ভাতা ছাড়া, তাদের কপালে কিছু জোটে না। তবে এখানে এড়িয়ে গেলে চলবে না- দলীয় লেজুড়বৃত্তি, কালো টাকার মালিকদের সঙ্গে মিলমিশ করে অনেকেই প্লট, ফ্ল্যাট ও ব্যক্তিগত যানের মালিক হয়েছেন।
কিন্তু তারা সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি এ কথাটি আমি বিনয়ের সঙ্গেই বলতে চাই। সাংবাদিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের আন্দোলনের প্রথম সারিতে থেকে অনেকের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে। তাদের এই ফুলে-ফেঁপে ওঠা দেখে ভাববেন না সাংবাদিকতার মধ্যে আলাদীনের চেরাগ রয়েছে। যেখান থেকে একটি জিন বের হয়ে এসে হুকুম তামিল করে। ভাগ্য ফেরায়।
রাজধানীতে কয়েক হাজার সাংবাদিক রয়েছেন যাদের জীবন ধারণে ন্যূনতম আয় নেই। কী ভীষণ আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন তারা! কিভাবে শোষিত বঞ্চিত হচ্ছেন! দেহত্যাগে মৃত্যু না হলেও এই জীবন-যাপন যেন তার চেয়ে কোনো অংশে দুর্বিষহ নয়। অনেকেই ঋণগ্রস্ত। চিকিৎসায় মিলছে না প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য।
এসব দেখে মনে প্রশ্নে ওঠে, আদতে সাংবাদিকরা কোন নিরাপত্তাটি আগে চান। আমরা কি সেই নিরাপত্তাটুকু আগে চাই- যেখানে আর কোনো ‘দুঃস্থ সাংবাদিক’ থাকবে না; আমাদের তাড়া করবে না কোনো আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, খুনির রোমশ হাত? আমরা চাই- রাত দিন পরিশ্রম করে, যতটুকু পারা যায় অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার আর সত্যকে তুলে ধরছেন যে সাংবাদিকরা, তারা পাবেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা, পেশার মর্যাদা। সাংবাদিক খুনের বিচার না হওয়ার যে দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতি, দীর্ঘসূত্রিতা তারও অবসান হবে। অন্তত সুবর্ণা নদীর পর আর কোনো সাংবাদিককে যেন অপঘাতে প্রাণ হারাতে না হয়।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে অনেক এগিয়েছে দেশ। সুউচ্চ অট্টালিকার সারি, বড় বড় রাস্তা, মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে আমরা ঠিকই পৌঁছেছি। কিন্তু আমরা কতোটা মানুষ হয়েছি, মানবিক হয়েছি, অন্যের মত ও সমালোচনা, সত্যকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা অর্জন করেছি সেটাও তো বিবেচনা করার বিষয়। এসব দিকে আমাদের অগ্রগতি না হলে সমাজ এগোবে না। সাগর-রুনিরা খুন হয়ে পড়ে থাকবেন বেড রুমে। ঘরের দরজা খুলে খুন হবেন সুবর্ণা নদী। news http://www.banglanews24.com