সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের এখন সংলাপের প্রয়োজন নেই

621

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচনের আর মাত্র চার মাস বাকি। এখন সংলাপের সময় নেই, সুযোগ নেই, এমনকি প্রয়োজনও নেই। আলোচনার মতো সময়ও হাতে নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি যে সহিংসতা চালিয়েছিল সে প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এবার সহিংসতার চেষ্টা করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।

আগামী অক্টোবরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠিত হবে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এই সরকারের আকার হবে ছোট, যারা বড় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা বাস্তবায়ন করবেন না। তারা কেবল রুটিনমাফিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহযোগিতা করবেন। ওই সরকারে কারা থাকবেন- সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ঠিক করবেন। তবে সংসদে যাদের প্রতিনিধিত্ব আছে, তার বাইরে অন্য কোনো দলের প্রতিনিধিদের এই সরকারে অন্তর্ভুক্তির কথা চিন্তা করার সুযোগ নেই। সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকায় বিএনপিরও এই সরকারে থাকার সুযোগ নেই।

গতকাল সোমবার সচিবালয়ে তার মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে সমকালসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। সংলাপ নিয়ে বিএনপির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি আরও বলেন, আসলে বিএনপি সংলাপের নামে স্ট্যান্টবাজি করছে। মুখে সংলাপের কথা বললেও তাদের অন্তরে সেটি নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ এখন অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগের জনমত, নৈতিকতা ও সততার ভিতও অত্যন্ত শক্তিশালী। জনগণের শক্তি ও আল্লাহপাকের ওপর ভরসা ও আস্থা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় কোনো বিদেশি শক্তি কিংবা তৃতীয় পক্ষের কোনো রকম চাপ অনুভব করছেন না তারা।

আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার কোনো ভূমিকা নেবে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে কেউ না এলে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কোনো অভাব হবে না। তবে নির্বাচন করা বিএনপির গণতান্ত্রিক অধিকার। তারা এই অধিকার প্রয়োগ করবে কি-না কিংবা গতবারের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে কি-না, সেটি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকারের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। আর নির্বাচন কারও জন্য বসেও থাকবে না, নির্বাচনী ট্রেন চলমান থাকবে।

কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে বিএনপির হুমকি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার। এতে সরকারের কিছু করণীয় নেই। তা ছাড়া একজন খালেদা জিয়াকে নিয়ে নিশ্চয়ই বিএনপি নয়। তাদের তো আরও নেতা রয়েছেন। একজন তো (তারেক রহমান) লন্ডনে আছেন। এখন বিএনপি নেতারাই সিদ্ধান্ত নিন, তারা নির্বাচনে আসবেন কি আসবেন না।

তৃতীয় পক্ষ থেকে সংলাপের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে সাড়া দেবেন কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা যখন যা করব, নিজেদের বিবেকবোধ এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থেই করব। জনগণের শক্তি ও মতামতের ভিত্তিতেই করব। এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রয়োজন হবে না।

আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনে বিএনপির দাবি প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনকালে নির্বাচনসংশ্নিষ্ট সব মন্ত্রণালয় এবং এ সংক্রান্ত সব দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে। কেবল সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় নির্বাচনে সেনা সদস্যের নিয়োগের বিষয়টি তাদের ওপর ন্যস্ত হবে না। সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন পড়লে ইসি সরকারকে অনুরোধ করবে। সরকার প্রয়োজন মনে করলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারে, না-ও পারে। তবে আগের নির্বাচনগুলোর মতো সেনাবাহিনী ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে থাকবে।

বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অভিযোগের জবাবে সেতুমন্ত্রী বলেন, মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি নেতাদের তথ্য-প্রমাণ সহকারে বলতে বলুন- কোথায় ও কীভাবে তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। সরকার যদি বাধা দিত তাহলে নয়াপল্টনের কার্যালয়ে বসে প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে অশ্রাব্য ও অশ্নীল ভাষায় গালিগালাজ ও মিথ্যাচার করা হচ্ছে, তা বন্ধ করা হতো, তাদের কণ্ঠরোধ করা হতো।

নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি জোটে আসতে চাইলে স্বাগত জানানো হবে।’ ১৪ দলের বাইরে থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে সম্প্রতি গিয়েছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গ তুলে ওবায়দুল কাদের জানান, সেখানকার আলোচনায় সিপিবি নেতারা জানিয়েছিলেন, বামপন্থিদের আটদলীয় জোটের বাইরে তারা অন্য কিছু চিন্তা করছেন না। আওয়ামী লীগের জোটে আসবেন কি-না এমন কোনো আশ্বাসও তারা দেননি। তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক কোনো জোটে তারা যাবেন না বলেই জানিয়েছেন। এর বাইরে বাসদ, বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও এলডিপি নেতাদের সঙ্গে ফোনালাপ অথবা বৈঠকের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো সবই আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে এককভাবে এবং বিএনপি এলে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করবে। এটি তো জাতীয় পার্টি প্রকাশ্যেই বলেছে। তবে নতুন নতুন মেরুকরণ নির্বাচন ও রাজনীতিতে খুবই জটিল সমীকরণ। এটি সময় সময় পরিবর্তন হয়। কাজেই এ মুহূর্তে এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা যাবে না।

আগামী নির্বাচনে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো সহিংসতার আশঙ্কা করছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সে রকম আশঙ্কা তো রয়েছেই। প্রতিদিনই গোপন বৈঠক হচ্ছে। দেশে হচ্ছে, বিদেশে হচ্ছে। সরকার সব খবরই জানে। তবে সরকারও প্রস্তুত আছে, সতর্ক আছে। বিএনপি যদি আবারও সংঘাতের পথে যায়, সহিংসতার চেষ্টা করে তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দাঁতভাঙা জবাব দেবো।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, সরকারের উন্নয়ন ও দলীয় ঐক্যই আওয়ামী লীগের চলার শক্তি। এ মুহূর্তে দলের মধ্যে ঐক্য আছে। ঐক্যবদ্ধ ছিল বলেই সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রার্থীরা জিতেছেন। এরপরও দলকে সম্পূর্ণ কলহমুক্ত ও নির্ভেজাল বলে দাবি করেন না তারা। দলের মধ্যে যেখানে যেটুকু সমস্যা আছে, ঢাকা থেকে দলীয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে অথবা তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে সমাধান করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটার হওয়া তরুণসমাজ ও নারীরাই হবে আওয়ামী লীগের বিজয়ের প্রধান শক্তি- এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেন তিনি।

জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা প্রার্থীরাই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে বর্তমান এমপিদের মধ্যে যারা জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য, তারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুতের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে জানালেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাম্প্রতিক আন্দোলনকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে এই আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার ও সহিংস করার চিত্রও তুলে ধরেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। শিক্ষার্থীদের সব দাবি বাস্তবায়নসহ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার ও তার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়াকে যৌক্তিক বলার অর্থই হচ্ছে মন্ত্রী হিসেবে তার দায়-দায়িত্ব নেওয়া। তিনি জানান, গত সাত বছরে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেননি তিনি। সবকিছুতে সফল হয়েছেন- এমন দাবি করেন না তিনি। তবে ছাত্রদের আন্দোলন তাকে সাহস জুগিয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে সব পক্ষকে সচেতন হওয়ার আহ্বানও জানান ওবায়দুল কাদের। news sours prothom alo