চট্টগ্রামে একবিংশ শতকের গণমাধ্যম শীর্ষক সেমিনার শনিবার

602

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর উদ্যোগে ‘একবিংশ শতকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম: সন্ধিক্ষণ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।

মহানগরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সকাল সাড়ে দশটায় অনুষ্ঠিতব্য এই সেমিনারে আইন প্রণেতা, রাজনীতিবিদ, নেতৃস্থানীয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেবেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট আয়োজিত জাতীয় সেমিনারের ধারণাপত্রে বলা হয়েছে: একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি তাড়িত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় ‘গণমাধ্যম’ সত্যিকারের সন্ধিক্ষণ পাড়ি দিচ্ছে। কথাটি বিশ্বের প্রেক্ষাপটে যেমন সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনিভাবে সঠিক। একদিকে প্রবল বেগে বাড়ছে অন-লাইন মিডিয়া, অন্যদিকে ক্ষয়ে হচ্ছে প্রিন্টেড মিডিয়ার আওতাভুক্ত ছাপানো পত্র-পত্রিকা। তরুণ, চলিষ্ণু, প্রযুক্তি-নির্ভর প্রজন্ম আজকের সংবাদ কালকের ছাপানো কাগজে পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। এতোটুকু সময় দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই বর্তমানের মানুষ।

এমন অনেক খবর আছে, যেমন বন্যা, দুর্যোগ, ট্রেন চলাচল, ফেরি পারাপার, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি খবরের জন্য তাৎক্ষণিক আপডেট জানা স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্যই মানুষের প্রয়োজন। এসব খবর পরদিন পড়ার কোনও হেতু বিদ্যমান পেশাগত জীবন বাস্তবতায় একেবারেই নেই। ফলে এখনকার খবর এখনই পাঠকের সামনে হাজির করার চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতায় বিশ্বব্যাপীই ব্যস্ত রয়েছে গণমাধ্যম।

অনলাইন মিডিয়া এ সুযোগ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ পাঠককে আকৃষ্ট করছে। সন্ধিক্ষণকে সামাল দিতে না পারায় মৃত্যুঘণ্টা বাজছে প্রথাগত সংবাদপত্রের। প্রতিদিনই কমছে তাদের প্রচার ও পাঠক।

অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব হারাচ্ছে বা অস্তিত্ব বাঁচাতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অপেক্ষাকৃত বড় কোনো হাউজে। বিভিন্ন গণ্যমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের তুলনাহীনভাবে একত্রিত হয়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে এক ধরনের মিশ্রণের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া অঙ্গনে তৈরি হচ্ছে একক আধিপত্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘মেগামিডিয়া’ কিংবা কখনো ‘ট্রান্সন্যাশনাল মিডিয়া কর্পোরেশন’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এরা বহু বিভাগীয় কোম্পানি। সম্প্রচার, প্রকাশনা, চলচ্চিত্র এবং সাউন্ড রেকর্ডিং-এর মতো বিবিধ গণমাধ্যম ক্ষেত্রে এরা কাজ করে।

বৈশ্বিক যোগাযোগ বাজারে এই ধরনের একীভূত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: আমেরিকান অনলাইন টাইম ওয়ার্নার, দ্য ওয়ার্ল্ড ডিজনি, বার্টেলসমান, ভিভেন্দি ফরাসি-কানাডা, নিউজ কর্পোরেশন অস্ট্রেলিয়া।

এভাবেই সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী তৈরি হচ্ছে ‘মিডিয়া মনোপলি’ বা ‘গণমাধ্যম একাধিপত্য’। আধিপত্য কত প্রবল, তার প্রমাণ হলো, ১৯৮৩ সালে ৫০ টি মিডিয়া কর্পোরেশন বিশ্বের সমুদয় তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতো।

২০০০ সালে দেখা যায়, ৫০টি নয়, মাত ৬টি মিডিয়া কর্পোরেশন পুরো বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। গণতন্ত্র ও তথ্যের অধিকারের দিক থেকে বিষয়টি বিপদের। এরাই মানুষের জানার অধিকারকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে নিজের এজেন্ডা প্রচার করতে পারছে।

ফলে গণমাধ্যম সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় মিডিয়া ডেমোক্রেসি, মিডিয়ালিজম, মিডিয়া পলিটিক্স, মিডিয়াক্রেসি, টেলিডেমোক্রেসি ইত্যাদি শব্দ ও প্রত্যয় সামনে চলে আসছে। এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গভীর ও প্রত্যক্ষ প্রভাব সম্পর্কেও কথা হচ্ছে। কারণ মানুষ তিনটি উপাদানের মাধ্যমে নিজেকে ঋদ্ধ ও তথ্যবহুল করতে পারে। এগুলো হলো: গণমাধ্যম, জনপ্রিয় ভাবনা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফলে গণমাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সহজে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রশাসনকে নানা দিক থেকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। তাই নীতি প্রণয়ন, আদর্শ প্রচার, মনোভাব গঠন বা পণ্য বিপণনে মিডিয়া এগিয়ে থাকছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হলি আর্টিজান বা হাওর কিংবা উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি তেমনই সামান্য কিছু উদাহরণ, যেখানে প্রতি মুর্হূতে ঘটনা চাঞ্চল্যকর পর্যায়ে বাঁক নিচ্ছিলো। নিজের, পরিবারের, সমাজের স্বার্থে সবাইকে উৎকর্ণ থাকতে হচ্ছিল চলমান খবরটির সব আপডেট জানার জন্য। এসব খবরের সঙ্গে জীবন-মরণের বিষয় জড়িত। আপনি ফেরি ঘাটে সপরিবারে আটকে আছেন কিংবা শহরের কোনও এক জায়গায় সন্ত্রাসী ঘটনার বা যানজটের জন্য আপনি অফিস থেকে বাসায় যেতে পারছেন না। তখন পরদিনের দৈনিক পত্রিকা নয়, নিউজপোর্টাল আপনার ভরসা স্থল।

এ রকমের বহুবিদ বাস্তবতার মধ্যে গণমাধ্যমের সর্বসাম্প্রতিক ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে নতুন করে আলাপ-আলোচনার দরকার আছে। বিশেষত জননিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা সঙ্কট মোকাবেলা ও সঠিক নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে। পাশাপাশি প্রচুর গণমাধ্যমের বিকাশের সুযোগ নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতা, চরিত্র হনন, মিথ্যা-বানোয়াট-উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচারের বিপদগুলোও বিবেচনায় নেওয়ার দরকার পড়ছে।

উদ্যোক্তারা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের উপরোক্ত বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে পালাবদল ঘটছে বাংলাদেশেও। ব্রিটিশ-পাকিস্তান-বাংলাদেশের প্রথাগত সংবাদপত্র তীব্র বেগে ডিজিটালাইজ হচ্ছে। আধুনিক ফর্ম ও প্রযুক্তি গ্রহণের দিকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রিন্টিং মিডিয়াকেও অনলাইন ভার্সন বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে আসতে হচ্ছে। যুগ-সন্ধিক্ষণের এই কাল-পর্বটি একই সঙ্গে সঙ্কট আর সম্ভাবনার। অনেকেই সঙ্কটে বিহ্বল হলেও কেউ কেউ প্রবহমান চ্যালেঞ্জকে আলিঙ্গণ করে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক অভিযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

জাতীয় সেমিনারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব, আইন প্রণেতা, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞরা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সন্ধিক্ষণ, সঙ্কট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে পেশাগত-বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক-তথ্যপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করবেন বলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।